ঢাকা, বুধবার ১৬, এপ্রিল ২০২৫ ৭:০৬:৩৩ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
মহাকাশ ঘুরে এলেন কেটি পেরিসহ ৬ নারী গাজায় নিহত আরও ৩৯ ফিলিস্তিনি, ৫১ হাজার প্রাণহানি শেখ হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঢাকার সড়কে সকালে গণপরিবহন কম, অফিসগামীদের ভোগান্তি ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বাংলা একাডেমিতে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে বৈশাখী মেলা অভিনেত্রী গুলশান আরা আহমেদ আর নেই

একাত্তরে ডা. বদরুন নাহারের নৌকায় ভাসমান যুদ্ধ

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১১:১৪ পিএম, ২৯ মার্চ ২০২১ সোমবার

ডা. বদরুন নাহার।  ছবি সংগৃহীত।

ডা. বদরুন নাহার। ছবি সংগৃহীত।

ময়মনসিংহের সন্তান ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী৷ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে গ্রামে গ্রামে ছুটোছুটি করে চিকিৎসা করেছেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের। অস্ত্র চালনা এবং আত্মরক্ষা কৌশলের উপর প্রশিক্ষণও নিয়েছে যুদ্ধের শুরুতেই। কুমিল্লা ও নোয়াখালীর ১১টি অঞ্চলে নৌকায় করে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে৷ যোদ্ধাদের জন্য কাজ করতে গিয়ে পড়েছেন নানা বিপদে। কিন্তু পিছ পা হননি কোনো অবস্থাতেই। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে কাজ করে গেছেন শক্তহাতে। আজও দেশকে ভালোবেসে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন বিনামূল্যে।
১৯৫০ সালের ১৫ জানুয়ারি ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী৷ বাবা সৈয়দ দরবেশ আলী এবং মা সৈয়দা হোসনে আরা বেগম৷ ১৯৬৯ সালে ঢাকা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে পড়ার সময় সমমনা রাজনৈতিক আদর্শের অন্যতম নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র তোফাজ্জল হায়দার নসু চৌধুরীর সাথে বিয়ে হয় তার। স্বামী-স্ত্রী দু'জনই দেশের মুক্তিযুদ্ধে একাত্ম ছিলেন৷
১৯৭১ সালে এমবিবিএস শেষ বর্ষের ছাত্রী ছিলেন বদরুন নাহার৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এই দেশপ্রেমী নারী৷ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য নি এবং তার স্বামী ২৫ মার্চ ঢাকা থেকে চাঁদপুরে চলে যান৷ চাঁদপুরে পৌঁছেই সেখানে প্রথম গঠিত স্থানীয় সরকারে যোগ দেন তারা৷ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১২০৪ সাব-সেক্টরের অধীনে জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বাধীন মধুমতী কোম্পানিতে মেডিকেল কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন ডা. বদরুন নাহার৷ ওই অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর এটিএম হায়দার৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের ওলিপুর গ্রামের প্রশিক্ষণ শিবিরে অস্ত্র চালনা এবং আত্মরক্ষা কৌশলের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন বদরুন নাহার৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পুরো নয় মাস তিনি ঘর ছেড়ে বাইরে বাইরে ছিলেন৷ এসময় তিনি অধিকাংশ সময় নৌকায় করে সাথী যোদ্ধাদের সেবা শুশ্রূষা করেছেন৷
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণ করে বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালীর ১১টি অঞ্চলে আহত মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করেছেন বীর সাহসী নারী ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী৷ ফলে এই ভয়াবহ সংকটের দিনে অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং কষ্টকর ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন তাকে৷ সেসব ঘটনার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, সেদিন ছিল ২৯ সেপ্টেম্বর৷ আশ্বিন মাসের শেষ দিন৷ হাজীগঞ্জের অফিস চিতোষী এলাকায় একটি স্কুলে পাকসেনাদের ঘাঁটি ছিল৷ আমি অনেকটা  দূরে নৌকায় ছিলাম৷ আমার কাছে কমান্ডার জহিরুল হক পাঠান খবর পাঠালেন, ওই স্কুলে পাকসেনারা বেশ কিছু নারীকে আটকে রেখেছে এবং তাদের উপরে পাশবিক নির্যাতন করেছে৷ খবর পেয়ে আমি রওয়ানা দিলাম৷ মুক্তিবাহিনী ইতিমধ্যে পাকবাহিনীর ওই ঘাঁটি আক্রমণ করে৷ দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চলার পর পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়৷ কিছু লাশ এবং কিছু মেয়ে সেখানে রয়ে যায়। আমি মনে করি, নয় মাসের যুদ্ধের অনেক ঘটনার মধ্যে এটিই ছিল কাছে সবচেয়ে হৃদয় বিদারক৷ আমি সেই স্কুলের ভেতরে গিয়ে দেখি ১২ থেকে ১৩ জন আতঙ্কিত মেয়ে সেখানে রয়েছে৷ পাকসেনাদের পাশবিক অত্যাচারের প্রতিটি চিহ্ন তাদের গায়ে৷ তারা সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় সেখানে ছিল৷ সেই স্মৃতি এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে। তাদের কথা স্মরণ করলে এখনও আমি কান্না ধরে রাখতে পারি না৷ এ অবস্থায় আমার এবং আমাদের সাথিদের কাপড়-চোপড় তাদের দেই। আশেপাশের মানুষদের সহায়তায়ও কিছু কাপড় পাই আমরা। এ সব কাপড় দিয়ে মেয়েগুলোকে জড়িয়ে ফেলি৷ এরপর তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেই৷ পরে আমি যে নৌকায় থাকতাম এবং বিভিন্ন জায়গায় যেতাম, সেই নৌকায় করে তাদের নিয়ে আসি৷ সেসময় আমার কাছেও খুব বেশি ওষুধ-পত্র ছিল না৷ তবু সেসব দিয়েই তাদের চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলি৷ পরে তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে তাদের পৌঁছে দেই৷ আমার কাছে এখনও মনে হয়, আমার চিকিৎসা জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন, আমি সেই নির্যাতিত মেয়েদের চিকিৎসা সেবা দিতে পেরেছি৷
যুদ্ধে উত্তার সারা বাংলাদেশ। জায়গায় জায়গায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ চলছে। গোলা-বারুদ আর বোমায় আওয়াজে প্রলঙ্করিকাণ্ড ঘটছে সারা দেশজুড়ে। এ অবস্থায় রাতের অন্ধকারে নৌকায় করে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিতেন ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী৷ খুব কঠিন ছিলো সেই পথচলা। জীকনের ঝুঁকি নিয়ে দিনে পর দিন তিনি ছুটে চলেছেন গ্রামের পর গ্রামে। একাধিকবার তার নৌকা পাকসেনারা আটকও করে৷ তবু নানা কৌশলে তিনি রক্ষা পান পাকহানাদারদের হাত থেকে৷
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফরিদগঞ্জ এলাকায় আমাদের ক্যাম্পের একটি ছেলে সম্মুখ যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়৷ তার নাম ফারুক৷ আমার কাছে তখন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছিল না৷ তবুও আমি তার শরীরের গুলি বের করতে সক্ষম হই৷ কিন্তু তার যে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিল তা কোনোভাবেই বন্ধ করতে পারিনি৷ এমনকি তাকে তখন অন্য কোথাও চিকিৎসার জন্য পাঠানোরও কোনো উপায় ছিল না৷ ফলে আমি অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারিনি৷ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সে আমার সামনে মারা যায়৷
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চাঁদপুরসহ কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলে নৌকায় করে ঘুরে ঘুরে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন ডা. বদরুন নাহার৷ কিন্তু যুদ্ধের সময় কোনো এলাকাতেই বেশি দিন অবস্থান করতে পারতেন না৷ কোনো বাড়িতে দুয়েকদিন থাকলেই সে এলাকায় খবর হয়ে যেত, এখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা এসেছে৷ সে কারণে খুব ঘন ঘন জায়গা বদল করতে হতো৷ এছাড়া দিনের বেলায় চলাফেরা করলে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল৷ তাই রাতের আঁধারে নৌকায় করে বিভিন্ন জায়গায় যেতেন তিনি৷ তবুও একাধিকবার পাকসেনাদের কবলে পড়েছেন এই সাহসী নারী৷
এমন বিপদজনক মুহূর্তে কীভাবে পাকসেনাদের কবল থেকে উদ্ধার পেয়েছেন সেসব ঘটনা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় বড় একটা সেতু আছে৷ ওই সেতুর নিচ দিয়ে যখন আমার নৌকা যাচ্ছিল, তখন পাকসেনারা আমাকে থামায়৷ কিন্তু যুদ্ধের সময় থেকে আমি আমার স্বাভাবিক কাপড়-চোপড় না পরে বরং বোরকা পরে ছদ্মবেশে থাকতাম৷ ওরা আমার নৌকা আটকায়৷ আটকিয়ে মাঝিকে জিজ্ঞেস করে৷ তখন মাঝি কোনো একটা জায়গার নাম বলে, উনাকে সেখানে রাখতে যাচ্ছি৷ আমার দুয়েকটা কথাবার্তাতেও তারা আমাকে আর সন্দেহ করেনি৷ ফলে সে দফা ছেড়ে দেয়৷ আরেকবার অনেক রাত্রে আমি নৌকায় করে যাচ্ছি৷ পাকসেনারা আমার নৌকা আটকায়৷ তখন আমার মাঝি আমাকে বললেন, খালাম্মা, আপনি পানিতে নেমে যান৷ আমি তো প্রথমে খুব আঁৎকে উঠলাম তার কথা শুনে৷ কিন্তু উপায় নেই দেখে শেষ পর্যন্ত পানিতে নেমে পড়ি৷ নৌকার পেছন দিক ধরে পানিতে আস্তে করে ভাসতে থাকি৷ পাকসেনারা নৌকাটা ভালোভাবে দেখল, কেউ নেই৷ মাঝিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, তিনি খালি নৌকা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন৷ তখন ওরা নৌকাটা ছেড়ে দিল৷ আমি যখন নৌকা ধরে পানিতে ছিলাম তখন আমার মনে হলো পাশ দিয়ে কী যেন ভেসে যাচ্ছে৷ সেই মুহূর্তে জীবনের ভয় তো সবারই হবে৷ তারপর সৈন্যরা যখন চলে গেছে তখন আমি দেখলাম, আমার পাশ দিয়ে দুই তিনটা মৃতদেহ ভেসে গেছে৷
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এমবিবিএস পরীক্ষা সম্পন্ন করেন বদরুন নাহার৷ এরপর চিকিৎসক হিসেবে সরকারি চাকুরিতে যোগ দেন৷ চাকুরির এক পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান ডা. বদরুন নাহার৷ সেই পদে থেকেই ২০০৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন তিনি৷ তবে চাকুরি থেকে অবসর নিলেও এখনও সেই মহান পেশায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন৷ পাশাপাশি সমাজ সেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন এই বীর নারী৷ এছাড়া তিনি মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সন্তানদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করেন৷
স্বাধীনতা যুদ্ধে ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরীর গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকার জন্য ২০১২ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়৷ বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে তার হাতেও স্বাধীনতা পুরস্কার তুলে দেন৷
তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমরা দেশ স্বাধীন করেছি৷ এখন এই স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং দেশকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলার দায়িত্ব তাদের৷ বাংলাদেশ যেন গোটা বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, সেজন্য আমরা যেমন দায়িত্বশীল হবো, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও তেমনি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে এটিই আমার বিশ্বাস এবং প্রত্যাশা৷