ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২১, নভেম্বর ২০২৪ ১৪:৪৩:৫৪ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
রাজধানীতে আজও অটোরিকশা চালকদের সড়ক অবরোধ আজ ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা নামল ১৪ ডিগ্রিতে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সুযোগ কাজে লাগাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সরকার সেনাকুঞ্জে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া শিখা অনির্বাণে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা

কবি রাধারাণী দেবী: এক অন্য জীবন

অনলাইন ডেস্ক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৫:৫৮ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ রবিবার

কবি রাধারাণী দেবী

কবি রাধারাণী দেবী

প্রথম বাধাটা এসেছিল নিজের বাপের বাড়ি থেকে। এশিয়াটিক ফ্লু নামের মারণব্যাধি কেড়েছিল স্বামী সত্যেন্দ্রনাথের জীবন।বয়স মাত্র তেরো বছর আট মাস। এয়োতির চিহ্ন মুছে গিয়েছে, খাওয়া দাওয়া থেকে পোশাকে অনেকটা বদলে গেছে অভ্যস্ত জীবনের ছন্দ।তবু শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় পরিজন বিশেষত শাশুড়ি মা সুশীলবালার স্নেহছায়া বাস্তবের রুক্ষতা থেকে অনেকখানি আড়াল করেছিল অকাল বিধবাকে। খাদ্য হিসেবে বরাদ্দ হয়েছিল হবিষ্যান্ন, একাদশীতে নির্জলা উপবাস। এরপরের ইতিহাস মরা গাছে ফুল ফোটানোর, অনুপ্রেরণার আরেক নাম কবি রাধারাণী দেবী, তিনি নবনীতা দেবসেনের জননী।
বিধবা কন্যার মা নারায়ণীদেবী ছেলে ও এক জামাইকে পাঠালেন শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়েকে ফিরিয়ে আনার জন্য।বললেন তাঁর মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ে হতে পারে না তাহলে তারা সমাজের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না। শাশুড়ি মা সুশীলাবালা দত্ত ঠিক করলেন, ফের বৌমার বিয়ে দেবেন। কিন্তু রাধারাণীর মা নারায়ণী সেকেলে মানুষ। সুশীলবালা প্রতিবাদে করলেও পরিস্থিতির চাপে পুত্রবধূ কে ফিরিয়ে দিলেন। মাথাভাঙায় বাপের বাড়ি এসে কন্যা বুঝল বৈধব্যের শুদ্ধাচার,নিয়মনিষ্ঠা কাকে বলে।থান পরানো হল, খুলে দেওয়া হল গায়ের গয়না, ছেঁটে দেওয়া হল মাথার কালো চুল।খাদ্য হিসেবে বরাদ্দ হল হবিষ্যান্ন, একাদশীতে নির্জলা উপবাস।

কিছু দিন পরে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এলেও মা প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছেন, রঙিন শাড়ি আর আমিষ আহার চলবে না। সে কথা জেনে কষ্ট পেলেন শাশুড়ি সুশীলাবালা। কিন্তু হাল ছাড়লেন না তিনি। আদরের বৌমার গায়ে ফের উঠল ইঞ্চিপাড় কাপড়, হাতে দু’গাছি চুড়ি, গলায় কানে সোনা। রাধারাণীকে তিনি দিলেন বড় ছেলের সম্মান!

মরা গাছে ফুল ফোটানোর চ্যালেঞ্জ রাধারানী নিয়েছিলেন।তাঁর গোটা জীবন যেন নাটক আর গল্পে মোড়া।সে তখন অন্তঃপুরিকা। সাহিত্য চর্চা আর নিয়মিত পড়াশোনা করে দিন কাটে।খাতার পর খাতা ভরিয়ে তোলেন।তাঁর লেখা প্রকাশের নেপথ্যের কাহিনী বেশ ইন্টারেস্টিং। আশুতোষ দত্ত ততদিনে কোচবিহার ছেড়ে কলকাতায় এসেছেন বাড়িতে ফিরেছে সাহিত্য মনস্কতার পরিবেশ।এই সময় রাধারাণীর ছোট পিসিমা চমৎকারিণী দেবী দেবরপুত্র নরেন্দ্র দেব কে দিয়ে তাঁর ভাইঝির কবিতা প্রতিভা যাচাই করতে চাইলেন।সেই কবিতা পড়ে সাহিত্য জগতের প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী নরেন্দ্র হতবাক। নিজের জবানিতে লিখেছেন " আমি কবিতা পড়ে অবাক হয়ে গেলুম"।নরেন্দ্রর উদ্যোগে রাধীর কবিতা প্রকাশ হতে লাগলো।

রাধারাণী কেন অপরাজিতা হলেন,কেন অপরাজিতা কে বারো বছর অজ্ঞাতবাসে রাখলেন সে কথা জানা যায় তাঁর লেখা একটি চিঠি থেকে। অপরাজিতার কবিতায় যারা তাঁকে বিশেষ ভাবে উৎসাহিত করেছিলেন তাদের মধ্যে প্রধান স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।কবি রাধারানী কে ডেকে পাঠিয়ে প্রশ্ন করেছেন,তখন রাধু বলেছেন "আপনার কাছে সত্য কথাই বলছি এই কবিতা পুরুষের রচনা নয়।মেয়েরই,হাতের রচনা... অপরাজিতা তাঁর আসল নাম নয়,ছদ্ম নাম। সময় হলেই সে আপনার সামনে এসে পরিচয় দিয়ে আপনাকে প্রণাম করে ধন্য হবে।এখন তাঁর আসার উপায় নেই '।

সাহিত্য জগতের কিছু অবিচারের বিরুদ্ধে রাধারানীর মনে যে প্রতিবাদ শানিত হচ্ছিল তার নান্দনিক প্রকাশ সম্ভব হয় 'অপরাজিতা'নামের দ্বিতীয় সত্তার সযত্ননির্মানে।সেই নির্মাণ এতটাই কুশলী যে ভাষাপ্রয়োগ, রচনাশৈলী, বিষয় নির্বাচনের পাশাপাশি সম্পূর্ণ ভিন্ন ছাঁদের হাতের লেখা আয়ত্ত করেছিলেন রাধারানী, অপরাজিতা দেবী নামে প্রকাশিত কাব্যের পান্ডুলিপি প্রস্তুত করার জন্য।

কবি নরেন্দ্র দেবের সাথে রাধারাণীর কবে প্রথম চাক্ষুস পরিচয় হয়েছিল তার দিনক্ষণ জানা নেই, তবে কাব্য-দীপালির প্রথম সংস্করণ সম্পাদনার সময় রাধারাণী দত্ত নরেন্দ্র দেব কে সাহায্য করেছিলেন।এটি প্রকাশিত হয় ১৯২৭সালে।এর চার বছর পরে দৈনিক বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হল চাঞ্চল্যকর সংবাদ, শিরোনাম "রাধারাণী -নরেন্দ্র বিবাহ, কন্যার অত্মসম্প্রদান"। সাহিত্য জগত শুধু নয় সেদিন আলোড়ন উঠেছিল সমাজে।বিংশ শতকের তিনের দশকে বাল্যবিধবার পুনর্বিবাহ যতেষ্ট চর্চার বিষয়।আর যার সঙ্গে বিয়ে হল তিনি বিপত্নীক নন।

রাধারাণী বিয়ের দিন লিলুয়ায় এসেছিলেন তাঁর প্রথম শ্বশুর বাড়ি থেকে। কাউকে কিছু বলেন নি।এই না বলে আসার অপরাধবোধে দীর্ণ হয়েছেন আমৃত্যু। মনে মনে মাকে কষ্ট পেতে দেখে কন্যা নবনীতা মাকে প্রশ্ন করেছেন কেন তিনি এই কাজ করেছিলেন,যারা তাঁকে এত স্বাধীনতা দিয়েছে, এমন কি নিজেরাই আবার তাঁর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। রাধারাণী মেয়েকে বলেছিলেন আমার ওপর গোটা পরিবারের নির্ভরতা বেড়েছিল।এই সময়ে বিয়ের কথা জানালে যদি ওদের খারাপ লাগত!হয়ত তিনি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না।তাই না জানিয়ে চলে এসেছিলেন।

১৯৩৪ সালের কথা, বিয়ের তিন বছর পরে নরেন্দ্রর মা মৃণালিনী আছেন তাদের দক্ষিন কলকাতার বাড়িতে। রাধারাণী তখন সন্তানসম্ভবা।হঠাৎ একদিন দুপুরবেলা সেই বাড়িতে হাজির সুশীলবালা।ঘোর লজ্জায় রাধারাণী, তাঁকে বুকে টেনে পরিস্থিতি সহজ করে দিলেন সুশীলবালাই।ছেলে হয়েছিল তবে রইল না বেশি দিন। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সে চলে গেল মায়ের কোল শূন্য করে।

তবে কী মা হওয়া তাঁর ভাগ্যে নেই! স্বামী নরেন্দ্র রাধারাণীর শরীরের অবস্থায় চিন্তিত।দূর্বল শরীরে হাঁপানির প্রকোপ বেড়েছে।শেষ পর্যন্ত ধন্বন্তরী চিকিৎসক শ্যামাদাস বাচস্পতি তাঁকে সুস্থ করলেন। পরামর্শ দিলেন হাওয়া -বাতাস খেলে এমন বাড়িতে থাকার।এরপর সম্পূর্ণ নিজের তৈরি নকশায় রাধারাণীর জন্য তৈরি হল বাড়ি নাম 'ভালো-বাসা'। সত্যিই সুস্থ হয়ে উঠলেন রাধারাণী,মনের মত করে সাজিয়ে তুললেন তাদের স্বপ্ননীড় 'ভালো-বাসা'। ততদিনে সাহিত্য ও ব্যক্তিগত জীবনে সে সুপ্রতিষ্ঠিত। আত্মীয় পরিজনরা সবাই তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন তারা আর দূরে থাকতে পারলেন না। রাধারাণীর প্রথম শ্বশুর বাড়ির লোকেরা যাতয়াত শুরু করলেন 'ভালো-বাসা'য়।

১৯৩৭ সালে আবার সন্তানসম্ভবা হলেন, ১৯৩৮ সালের ১৩ জানুয়ারি ওই বাড়িতে এল নতুন এক প্রাণ, রবীন্দ্রনাথ নামকরণ করলেন 'নবনীতা'। সেই মেয়েও পরবর্তীকালে হয়ে উঠলেন বাংলা সাহিত্যের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব যাকে মানুষ চেনে নবনীতা দেবসেন নামে।

সূত্র: ফেসবুক থেকে