ঢাকা, সোমবার ২৫, নভেম্বর ২০২৪ ৯:৩০:২৪ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাব জব্দ ১০ সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাব জব্দ মিরপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, নারী-শিশুসহ দগ্ধ ৭ ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৩৮, লেবাননে ৩৩ প্রাণহানী প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়েই প্রিয়াঙ্কার বাজিমাত বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন ব্রিটিশ রাজা চার্লস

ক্রমশ বিপন্ন হচ্ছে জলের পাখি ডাহুক

আইরীন নিয়াজী মান্না | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৭:৩৫ পিএম, ৫ জানুয়ারি ২০২৪ শুক্রবার

বিপন্ন হচ্ছে জলের পাখি ডাহুক

বিপন্ন হচ্ছে জলের পাখি ডাহুক

ডাহুক, এ নামটি প্রতিটি বাঙালির কাছে একটি অতিচেনা নাম। বাংলা কবিতায় বার বার উঠে এসেছে এ পরম সুন্দর পাখি। চিরবিরহী পাখি ডাহুক। ডাহুকের বিরহ ছড়িয়ে আছে বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে, কাব্যে।

বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জীবনানন্দ, ফররুখ আহমদ, আল  মাহমুদের কাব্যের অন্যতম অলংকার। কখনো রূপকে, কখনো প্রতীকে।  না বলা অনেক কথা, কথা হয়ে উঠেছে তাদের কবিতায় ডাহুক-ডাহুকীর ডাকে।

জলচর এই পাখিটি  ভীষণ রোমান্টিক। যখন সঙ্গীর খোঁজ না পায়, সারা দিন রাত ডাকতে ডাকতে গলা চিরে রক্ত উঠে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে মৃত্যুর কোলে।  সত্যি কি মর্মান্তিক! তবু তাতেই স্বার্থক তাদের জীবন। ভালোবাসা অসীম, চিরন্তন।

ডাহুক খুব সতর্ক পাখি। আত্মগোপনে পারদর্শী। পাখিটি খুব ভীরু প্রকৃতির বটে।  গ্রামাঞ্চলের পুকুর পাড়ের ঝোপঝাড়ে সন্ধ্যেবেলা ডাহুকের ডাক শোনা যেত। গভীর রাতেও ডাহুকের ডাকে অনেকের ঘুম ভাঙতো। তবে আজকাল আর ডাহুকের কণ্ঠ শোনা যায় না।

একসময় বর্ষা ও শরতে ডাহুকরা বাড়ির গৃহপালিত হাঁস মুরগির সঙ্গে বেড়াতো। এখন আর তাদের আনাগোনা দেখা যায় না। চোখে পড়ে না। ডাহুক পাখি এখন হারিয়ে যেতে শুরু করেছে।

মানুষের সাড়া পেলেই লুকিয়ে পড়া এই পাখি নিয়ে আলা মাহমুদ শেষবারের মতো খুঁজে ফিরেছেন তার স্মৃতি।

‘স্মৃতির মেঘলাভোরে শেষ ডাক ডাকছে ডাহুক
অদৃশ্য আত্মার তরী কোন ঘাটে ভিড়ল কোথায়?’

ডাহুক স্ত্রী-পুরুষ দেখতে প্রায় একই রকম। ডাহুক আকৃতিতে মাঝারি। লেজ ছোট।  পা লম্বা। বেশ লম্বা পায়ের আঙুলও। ডাহুকের পিঠের রং ধূসর থেকে খয়েরি-কালো হয়।  মাথা ও বুক সাদা।  লেজের নিচের অংশে লালচে আভা। ঠোঁট হলুদ।  ঠোঁটের উপরে আছে লাল রঙের একটি ছোট্ট দাগ। লাল লেজ ও ডানার দু’প্রান্তে ওরা শিল্পিত ভঙ্গিতে কাঁপন তুলে নাচায়। ডানার নিচে, বুকের দু’পাশটা কালো। ঠোঁট হলুদ। ঠোঁটের উপরিভাগের গোড়াটা লাল। পা হলুদাভ লালচে-সবুজ। পায়ের লম্বা ও ছোট আঙুলগুলোর রঙ একই রকম। চোখ কালো তবে বৃত্ত লাল।

ডাহুক খুব সুন্দর পাখি।  জল এদের প্রধান আশ্রয়।  জলাভূমি এদের বেশি পছন্দ বলে সেখানেই বেশি দেখা যায়। ছোট ছোট ডোবা-নালা, জলভরা ধানক্ষেত, বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড়ের পাড়, পুকুর-দিঘি, খাল, নদীর পাড়ও এরা পছন্দ করে। ঘুরে বেড়ায় একাকী কখনো বা জোড়ায় জোড়ায়।

মাঝে মাঝে পোষমানা ডাহুকের স্ত্রী পাখিকে বলা হয় ডাহুকী।  ডাহুকী নিয়ে প্রকৃতি, লুকানো জীবনের প্রাণবন্ত কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন,

‘মালঞ্চে পুষ্পিতা লতা অবনতমুখী,-
     নিদাঘের রৌদ্রতাপে একা সে ডাহুকী
বিজন-তরুর শাখে ডাকে ধীরে ধীরে
     বনচ্ছায়া-অন্তরালে তরল তিমিরে।’

কিন্তু পোষমানার পর আমাদের দেশের এক শ্রেণীর অসাধু মানুষ এদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে অন্য ডাহুক পাখি শিকার করে।  কারণ একটির ডাকে কাছাকাছি থাকা অন্য পাখিটি চলে আসে।

বাসা তৈরি করে মাটিতে, ঝোপের তলায়।  প্রজননকাল আষাঢ়-শ্রাবণ। এই সময় তাদের মৃত্যুর হারও বেশি।  ডিম পাড়ে ৬-৭টি । ডিমের রং ফিকে হলুদ বা গোলাপি মেশানো সাদা। ডিমে তা দেয় স্ত্রী-পুরুষ উভয় মিলে।  তবে অদ্ভুত ব্যাপার বাচ্চাদের রং হয় কালো।

চণ্ডীদাস তার কবিতায় বলছেন,
‘ভাদর মাঁসে অহোনিশি আন্ধকারে
শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহল।
তাত না দেখিবোঁ যবেঁ কাহ্নাঞিঁর মুখ
চিনি-তে মোর ফুট জায়িবে বুক।’

অর্থাৎ কবি বলছেন, শিখি, মানে ময়ুর, ভেক ও ডাহুক পাখির কোলাহল এ সময় শোনা যায়।  আসলেই, এ সময় নতুনভাবে সজীব হয়ে ওঠে প্রকৃতি। কলকাকলি মুখর পরিবেশে নতুন কিছু খুঁজে থাকে সে।  নতুন কিছু পাবার আর নতুন কিছু দেবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, ভাদ্র তার দান ভাণ্ডার খুলে বসে।  প্রকৃতির কাছ থেকে তার অপার সৌন্দর্যকে নিয়ে, ভাদ্র বিলিয়ে দিতে চায় সবার কাছে।  আর এই সময় সবাই মিলে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়।  ডাহুকের ক্ষেত্রে কথাটা একবারেই ঠিক। 

সারা বছর চুপচাপ থাকলেও বর্ষা মৌসুমে কুক্ কুক্ ডাকা-ডাকিতে চারপাশ মুখরিত করে তোলে। গলার স্বর বেশ চড়া। দুপুরে অথবা গভীর রাতে এদের ডাক প্রায় ৫০০ মিটার দূর থেকেও স্পষ্ট শোনা যায়। বেশি ডাকে ভোররাতে, দুপুরে, শেষ গোধূলি ও গভীর রাতে।

শামুক, ক্ষুদ্র কীট, উদ্ভিদের ডগা এদের প্রিয় খাবার। ডাহুক অন্য পাখিদের মত বচ্চাদের মুখে করে খাওয়ায় না। বিশেষ করে মা ডাহুকী কখনেই এটা করে না। প্রাকৃতিক নিয়মে বাচ্চাগুলো ডিম থেকে বেরিয়েই লাফিয়ে পড়ে মাটিতে।  তারপর মা-বাবার সঙ্গে পিছে পিছে ঘুরে খাবার খায়।

ডাহুকের বৈজ্ঞানিক নাম Amaurornis phoenicurus. গোত্র Rallidae. ডাহুকের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ লাললেজী কালো পাখি (গ্রিক: amauros = কালচে, ornis = পাখি; লাতিন: phoenicurus = লাল লেজের গির্দি)।

কিন্তু মায়াবী এই পাখিটি চোরা শিকারি আর বাসস্থানের অভাবে দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

বিলুপ্তির পথে থাকা এই পাখিটিকে অন্যরা ভুললেও কবি, লেখকরা বোধহয় কোনোদিনই ভুলবেন না। কারণ ডাহুক-ডাহুকী-এদের ডাক, কষ্ট অনেকের আশ্রয়।

আর ফররুখ আহমেদ তার বিখ্যাত ‘ডাহুক’ কবিতায় তাই তো বলেছেন-

গুলে বকৌলির নীল আকাশ মহল
হয়ে আসে নিসাড় নিঝুম
নিভে যায় কামনা-চেরাগ;
অবিশ্রান্ত ওঠে শুধু ডাহুকের ডাক।
কোন্ ডুবুরির
অশরীরী যেন কোন্ প্রচ্ছন্ন পাখির
সামুদ্রিক অতলতা হতে মৃত্যু-সুগভীর ডাক উঠে আসে।

ডাহুক বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। কোনো কোনো জায়গায় এদের ডাইক, পান পায়রা, ধলাবুক ডাহুক নামেও ডাকা হয়। 

কিন্তু আমাদের দেশে পাখিটি এখন আর ভালো নেই। দ্রুত নগর বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে নদী, খাল-বিল আর সুন্দর এই পাখি ডাহুক।

লেখক পরিচিতি: আইরীন নিয়াজী মান্না, আহবায়ক- বাংলাদেশ বার্ড ওয়াচার সোসাইটি।