ঢাকা, শনিবার ০৪, জানুয়ারি ২০২৫ ৭:৫৫:১৮ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন রাজধানী, হেডলাইট জ্বালিয়ে চলছে গাড়ি ব্যক্তিসত্তা জাগ্রত হলে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব: প্রধান উপদেষ্টা কনকনে ঠান্ডায় বিপর্যস্ত উত্তরের জনজীবন ২০২৪ সালে হত্যার শিকার ৫২৮ নারী ও মেয়েশিশু: মহিলা পরিষদ খালেদা জিয়া লন্ডন যাচ্ছেন কবে, জানা গেল চলতি মাসে শীত কেমন পড়বে, জানাল আবহাওয়া অফিস

ঝুড়ি পিঠায় জীবন চলে যমুনাপাড়ের নারীদের

নিজস্ব প্রতিবেদক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:০৯ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ মঙ্গলবার

সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবার ঝুড়ি পিঠা। সুস্বাদু ঝুড়ি পিঠা গ্রামবাংলার নারী-পুরুষসহ সব বয়সের মানুষে কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। সারা বছরই হাটে-বাজারে ঝুরি পিঠার চাহিদা রয়েছে। এই ঝুড়ি পিঠা তৈরী করে জীবিকা নির্বাহ করছেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের যমুনাপাড়ের ভাঙন কবলিত কয়েকশ পরিবার। 

এক সময় যাদের ঘর-বাড়ি সবই ছিলো, এখন তাদের এতটুকু আশ্রয়ও নেই। বাঁধের কিনারেই ঝুপড়ি ঘর তুলে সেখানেই বসবাস করেন যমুনার ভাঙনে সর্বস্ব হারানো অসহায় মানুষ। সর্বস্ব হারিয়ে অসহায় মানুষগুলো আয়ের অন্য কোনো পথ না পেয়ে ঝুড়ি পিঠা তৈরী করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা।

 শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের হাটপাচিল ছোট গ্রামটিতে যাওয়ার পর দেখা যায় চোখে পড়ে রাস্তার দুই পাশের ফাঁকা জায়গায় ঝুড়ি পিঠাগুলো রোধে শুকার দৃশ্য।


এ সময় কথা হয় গ্রামটির কয়েকজন বাসিন্দার সাথে। তারা জানান, এক সময় ঘর-বাড়ি ও জমিজমা ছিলো তাদের। বর্তমানে তাদের মাথাগোজার মতো আশ্রয়ও নেই। বাঁধের কিনারেই ঝুপড়ি ঘর তুলে সেখানেই বসবাস করছেন যমুনার ভাঙনে সর্বস্ব হারানো অসহায় এসব মানুষগুলো। এদের মধ্যে কেউবা অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে সেখানেই ছোট্ট একটি ঘর তুলে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।

 জানা যায়, প্রতিদিন ভোরে বাঁধের প্রতিটি ঝুপড়ি কুঁড়েঘরে নারীদের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। বর্তমানে ৩ শতাধিক পরিবারের অন্তত ১ হাজার নারী-পুরুষ ঝুড়ি পিঠা তৈরির সঙ্গে যুক্ত আছেন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এই ঝুড়ি পিঠা দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যাচ্ছে। বছরের অধিকাংশ সময় এই ঝুড়ি পিঠা তৈরি হলেও শীতকালে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল ও মেলার বাজারে এর চাহিদা বেশি থাকে। এ কারণে শীতকালকে পিঠাটি তৈরির প্রধান মৌসুম হিসেবে ধরা হয়।

কথা হয় ঝুড়ি পিঠা তৈরির সঙ্গে জড়িত একাধিক নারী-পুরুষের সঙ্গে। তারা জানান, প্রতিদিন ভোররাত থেকে শুরু হয় তাদের কর্মযজ্ঞ। প্রথমে চুলার ওপর বড় একটি পাতিলে পানি গরম করে এতে পরিমাণমতো আতপ চালের গুঁড়া ও লবণ দিতে হয়। এরপর সেগুলো সিদ্ধ করে খামির তৈরি করা হয়। এ পর্যায়ে খামির থেকে ছোট ছোট বল আকৃতির দলা তৈরি করা হয়। সেই দলাগুলো ঝাঁজর বা মাটির ছাঁচের ওপর ঘষে ঘষে কাঁচা ঝুরি তৈরি করা হয়। পরে সেই ঝুড়ি ৩-৪ দিন রোদে শুকিয়ে বাড়িতে রান্না ঘরে চুলার আগুনে নারীরা বালু দিয়ে ভেজে খাবারের উপযোগী করে থাকেন। পরে সেগুলো মাটির পাত্রে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয়।


তারা আরো জানান, বর্তমানে ঝুড়ি পিঠার চাহিদা রয়েছে। এই পিঠা তৈরিতে নারী-পুরুষ সবাই মিলে কাজ করেন। রাত-দিন পরিশ্রম করে পিঠা বানানো হয়। তাদের তৈরি ঝুড়ি পিঠা দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়। শীতকালে গ্রামীণ মেলা, ধর্মীয় সভা থাকায় ঝুড়ি পিঠার চাহিদা আরও বেড়ে যায়। 

বাড়ির পাশের উঠানে ঝুড়ি শুকাচ্ছিলেন তানিয়া খাতুন (৩২) নামে এক গৃহবধূ। তিনি বলেন, “স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি সবাই মিলে ঝুড়ি তৈরির কাজ করি। এতে যা উপার্জন হয় তা দিয়ে পরিবারের খরচ চলে। সংসারের অন্য কাজের ফাঁকে এ কাজ করি সবাই মিলে। দিনে ৮০ কেজি ঝুড়ি তৈরি করতে পারি।”

আমিনা খাতুন, শেফালী বেগম, জোবেদা খাতুনসহ কয়েক নারী বলেন, “এক সময় আমাদের বাড়ি-ঘর, ফসলি জমি ও গোয়ালে গরু ছিলো। সব মিলে আমাদের সংসার ভালোই চলতো। হঠাৎ করে বাপ-দাদা ও স্বামীর ভিটা রাক্ষসী যমুনার ভাঙনে হারিয়ে গেছে। আমাদের কোনো জমি-জমা না থাকায় বর্তমানে সবাই ওয়াপদার ঢালে, আবার কেউ অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে ঝুপটি ঘর তুলে বসবাস করছি। আমাদের আয়ের অন্য কোনো উৎস না থাকায় সবাই মিলে ঝুড়ি পিঠা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছি।”

ঝুড়ি তৈরীর কারিগর আব্দুল মালেক বলেন, “এক বস্তা আটার ঝুড়ি তৈরি করতে ৪ হাজার টাকা খরচ হয়। বিক্রি হয় ৪ হাজার ২শ থেকে ৪ হাজার ৩শ টাকায়। যদি আকাশের অবস্থা খারাপ হয় তাহলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে।” 

আয়মনা বেগম (৫০), আলেয়া বেগম (৪৮) ও সুফিয়া খাতুন বলেন, “কেজি প্রতি ঝুরি বিক্রি হয় ১০০-১২০ টাকায়। কেজিতে তাদের ১৫ থেকে ২৫ টাকা লাভ হচ্ছে। তাদের তৈরি ঝুড়ির চাহিদা থাকায় বিক্রিতেও কোনো বেগ পোহাতে হচ্ছে না। বাড়ি থেকেই পাইকারেরা এগুলো সংগ্রহ করেন।”

প্রধান শিক্ষক লোকমান হোসেন সরকার বলেন, “হাটপাচিল গ্রামের এটাকে কুটিরশিল্প বলব। চালের কুঁড়ো থেকে সুস্বাদু খাবার তৈরি হচ্ছে। সারা বাংলাদেশের মধ্যে সুস্বাদু খাবার। খোলামেলা জায়গায় তৈরি হয়। নদী ভাঙন কবলিত খেটে খাওয়া মানুষগুলো ভোররাত থেকে শুরু করে দিনভর পরিশ্রম করে থাকেন এটি তৈরি করতে।” 

পাইকারি ঝুড়ি ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন বলেন, “প্রায় ৮ বছর ধরে আমি এখান থেকে ঝুড়ি পাইকারি ধরে কিনে বিভিন্ন গ্রামের জলসায়-মেলাতে বিক্রি করছি। নানা উৎসবসহ গ্রামীণ মেলায় ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক খাবার হিসেবে ঝুড়ি পিঠার ব্যাপক চাহিদা আছে। ঝুড়ি তৈরি করে বিক্রিতে কোনো কষ্ট করতে হচ্ছে না। লাভও একেবারে কম হচ্ছে না।” 

হাট পাঁচিল গ্রামের চালকল মালিক আব্দুল আলিম বলেন, “ঝুড়ি তৈরিকে কেন্দ্র করে গ্রামটিতে এখনো চারটি চালকল আছে। ঝুড়ি তৈরির জন্য এসব চালকল থেকেই আতপ চালের গুঁড়া নিয়ে থাকেন প্রস্তুতকারকরা। অনেককে বাকিতেও দেওয়া হয়। পরে বিক্রি করে সময় মত টাকা দিয়ে থাকেন তারা।”

 

কৈজুরী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য মিনা খাতুন বলেন, “এই গ্রামের নারীরা কঠোর পরিশ্রম করে সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে এই ঝুড়ি তৈরির কাজ করেন। তারা অনেক কষ্ট করে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। ঝুড়ি তৈরীর প্রয়োজনীয় পুঁজি সহায়তা পেলে এ পেশায় তারা আরো ভালো করতে পারবেন।”