ঢাকা, রবিবার ২৪, নভেম্বর ২০২৪ ১০:৫৫:৫৫ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
কুড়িগ্রামে বাড়ছে শীতের প্রকোপ, তাপমাত্রা নামল ১৫.৬ ডিগ্রিতে সাময়িক বন্ধের পর খুললো যমুনা ফিউচার পার্ক ডেঙ্গুতে আরও ১০ জনের প্রাণ গেল ডেঙ্গুতে এ বছরেই ৫১ শিশুর প্রাণহানি মাকে হত্যা করে থানায় হাজির ছেলে

নারীর মুক্তি কীসে?

সজীব সরকার

প্রকাশিত : ০৫:৪২ এএম, ১২ নভেম্বর ২০১৩ মঙ্গলবার

সজীব সরকার

সজীব সরকার

আধুনিক বিশ্বের অন্যতম একটি ভাবনা হলো নারীর মুক্তির ভাবনা৷ নারীবাদী আন্দোলন শুরুর পর গত কয়েক দশকে ‘নারীর মুক্তি’ এখনকার অন্যতম এজেন্ডা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ কিন্তু নারীর মুক্তি আসলে কীসের মুক্তি? কে দেবে এ মুক্তি? কীভাবে বা কীসে মিলবে এ মুক্তি? – এসব প্রশ্নের উত্তর আজও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন৷

একাডেমিশিয়ানদের দৃষ্টিভঙ্গির সমাজতত্ত্ব বিশেস্নষণ করলে দেখা যাবে, নারীর মুক্তি বলতে এখানে মূলত নারীকে পুরুষের অধীনতা থেকে বের করে নিয়ে আসার ওপর জোর হয়৷ অ্যাকাডেমিক তত্ত্ব ও মাঠ পর্যায়ে আন্দোলনের অভিজ্ঞতা বলে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব ৰেত্রে নারীকে স্বাধীনতা দিতে হবে; এসব ক্ষেত্রে নারীর ভাবনাকে পুরম্নষের দ্বারা প্রভাবিত হতে দেয়া যাবে না৷ অর্থনীতি, রাজনীতি, শিৰাসহ নারীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনে পুরম্নষের কোনো অযাচিত, অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ বা প্রভাব থাকবে না৷ কিন্তু এমনটি নিশ্চিত করতে হলে সর্বাগ্রে যা যা দরকার তা হলো নিজের মন ও শরীরের ওপর নারীর পরিপূর্ণ অধিককারের স্বীকৃতি; বিশেষ করে বাংলাদেশে নারীরা পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র তো দূরে থাক – নিজেদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে পর্যন্ত নিজেদের মতামত বা পছন্দ প্রকাশ করতে পারে না৷ এমন একটি অবস্থায় বৃহত্তর আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে নারীর মুক্তির কথা না ভেবে আগে বরং নারীর ব্যক্তিগত পরিসরে তার পছন্দ-অপছন্দ তথা অধিকার প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করা বেশি জরম্নরি৷

আমাদের দেশের মেয়েদের জীবন একান্তই পুরুষ-নির্ভর; এই ‘পুরুষ’ চরিত্রেরা কখনো তার বাবা, কখনো ভাই, কখনো প্রেমিক বা স্বামী এবং কখনো তার ছেলে (সন্তান) হিসেবে নারীদের জীবনের সবকিছু নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে৷ কী খাবে আর কী খাবে না, কী পরবে কী পরবে না, কোথায় যাবে আর কোথায় যাবে না, ঘর থেকে বেরোবে কি বেরোবে না – এই ধরনের যাবতীয় ছোট-খাট কিন্তু জরুরি বিষয়গুলো সবসময় পুরুষেরা নির্ধারণ করে দেয়৷ এমনকি নারীর সারা জীবনের সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোও – যেমন: কাকে বিয়ে করবে আর কাকে করবে না – এটিতেও নারীর কথা বলার কোনো সুযোগ নেই৷ সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, একটি সন্তান একজন নারীকেই তার শরীরে ধারণ করতে হয় অথচ এখানেও নারীর কোনো মত প্রকাশের সুযোগ থাকে না – সন্তান কখন নেবে বা নেবে না কিংবা কয়টি নেবে বা আদৌ নেবে কিনা৷ অর্থাত্‍ একজন নারীর তার নিজের ওপরই কোনো অধিকার নেই : না মনের ওপর আর না দেহের ওপর!

এই যেখানে বাস্তবতা, সেখানে ‘নারীর মুক্তি’ কথাটির একটি মানানসই ব্যাখ্যা আগে দাঁড় করানো দরকার৷ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এর সর্বজনীন একটি ব্যাখ্যা অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু বিদ্যমান সমাজ-বাস্তবতার নিরীখে প্রতিটি সমাজে নারীর মুক্তির বাস্তবসম্মত অর্থ আগে তৈরি ও তা বাসত্মবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে৷ এ জন্য একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রমের পরই কেবল আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে বিষয়টিকে বিবেচনা করতে হবে৷ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, পৃথিবীর সব দেশে নারীদের পিছিয়ে থাকা বা এগিয়ে যাওয়ার চিত্র বা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রত্যাশার ধরন এক ও অভিন্ন নয়৷ তাই বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটের বিপরীতে স্থানিক পর্যালোচনা ও এর পরই কেবল আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিজেদের তুলনা করাই যুক্তিযুক্ত হবে৷ না হলে হিতের বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না৷

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর মুক্তি বলতে ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র – সব পর্যায়ে নারীর মত প্রকাশ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা এবং শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগ ও অধিকারের পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়গুলোতে বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার৷ আর এসব বিষয়ে কাঙ্গিত পরিবর্তন আনতে হলে সমাজ কিংবা দেশ বদলানোর মতো ভারি কাজ কাঁধে তুলে নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই; এজন্যে শুধু নিজের মনোভাবের পরিবর্তন দরকার৷ প্রতিটি ব্যক্তি যদি শুধু নিজেকে নারী-পুরুষ ইস্যুতে মার্জিত, ভারসাম্যপূর্ণ, সহনশীল, সহানুভূতিপূর্ণ, নিরপেক্ষ ও যৌক্তিক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে আর সংঘবদ্ধ সমাজ বিপ্লবের মতো কষ্টসাধ্য কর্মবিপ্লবের কোনো প্রয়োজন পড়ে না৷ অনেকের মধ্যেই জেন্ডার ইস্যুতে ইতিবাচক ও সহনশীল মনোভাব তৈরি ও প্রকাশের চেষ্টা রয়েছে, কিন্তু কর্মকান্ডের প্রতিফলন দেখা যায় খুব কমই৷ এর একটি বড় কারণ হতে পারে, জেন্ডার ইস্যু মানুষের মনোজগতে একটি একাডেমিক বিষয় হিসেবে চিত্রিত হয়ে গেছে৷ এই ইস্যুতে আন্দোলন-বিপ্লবের ধরন এজন্যে অনেকটাই দায়ী৷ আর এই ইস্যুতে কথা বলার চরিত্রে তাই প্রথাগত পুঁথিগত বিদ্যা-শিক্ষার ওপর নিশ্চিত নির্ভার হয়ে বসে থাকলে এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন সত্যিকার অর্থে হবে না আর হলেও তা টেকসই হবে না৷ তাই সামষ্টিক আকারে শুধু পুস্তক-নির্ভর কর্মপরিকল্পনা ওপর নির্ভর না করে প্রতিটি পরিবারে প্রতিটি সদস্যের মধ্যে এই বোধ জাগ্রত করা জরুরি যে, জেন্ডার-ভারসাম্য বা জেন্ডার-সমতা মানে পুরুষ-বিদ্বেষ কিংবা পুরুষ-বিরোধিতা নয়৷ জেন্ডার ইস্যু শুধু নারীর কোনো বিষয় নয় – নারী-পুরুষ উভয়েই এর আলোচ্য ও বিবেচ্য৷ আর এর সঙ্গে প্রথাগত সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধেরও কোনো বিরোধ নেই৷ এই বোধ জাগ্রত করা গেলে প্রতিটি ব্যক্তিই এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠবে এবং শুধু পরীক্ষার খাতায় লেখা বা সভা-সেমিনারে বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সত্যিকার অর্থেই এই সমতা অর্জনে আন্তরিক হয়ে উঠবে৷ এতে আর জেন্ডার-সেনসিটিভ হতে গিয়ে কেউ পুরুষ-বিদ্বেষীও হয়ে উঠবে না আর সামাজিক বা ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিপন্থী মনে করে কেউ জেন্ডার-সমতার পক্ষে আন্দোলনের পথে বাধাও হয়ে দাঁড়াবে না৷

অর্থাত্‍ নারীর মুক্তি নিশ্চিত করতে আন্দোলন করার আগে আসলে নারীর মুক্তির ‘মানে’টুকু নির্ভুলভাবে বোঝা এবং কীসে মিলবে সেই মুক্তি – সেই লক্ষে নির্ভুল ও উপযুক্ত কর্মপন্থা নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি৷

লেখক: সজীব সরকার; স্টেট ইউনির্ভাসিটি অব বাংলাদেশ-এর জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক এবং গবেষক৷

mail : [email protected]