ঢাকা, সোমবার ১৪, এপ্রিল ২০২৫ ২৩:২০:৫৩ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
উৎসবের আমেজে শেষ হলো ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ ১৪ ঘণ্টা পর উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার রেলরুট সচল জাতীয় সংগীতের মধ্যদিয়ে শেষ হলো বটমূলের বর্ষবরণ বর্ষবরণে ঢাবি এলাকায় উৎসবের ঢেউ, বর্ণিল শোভাযাত্রা শুরু রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু আজ পহেলা বৈশাখ, স্বাগত ১৪৩২

প্রয়াণদিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি: চিরসবুজ এক মহানায়িকার গল্প

বিনোদন ডেস্কঃ | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১০:৪১ এএম, ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ মঙ্গলবার

সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

সুচিত্রা সেনের কথা মনে আসলে সবারই কম-বেশি রোমান্টিকতা ভর করে। তাকে ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে আসে তাতের শাড়ি পড়া, কপালে টিপ ও মাঝ বরাবর সিঁথি করা লম্বাটে গড়নের এক যুবতী নারী। বাংলা চলচ্চিত্রের অভিনয় ও ভাব-ভঙ্গিতে নতুন ধারার সৃষ্টি করে বাঙালি হৃদয় জয় করেছেন তিনি। রমা সেন থেকে হয়ে ওঠেছেন সুচিত্রা সেন। চিরসবুজ এই নায়িকার মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) প্রয়াণ দিবস।

১৯৩১ সালে জন্ম নেওয়া এই মহানায়িকা ছাড়া বাংলা চলচ্চিত্র ও ভক্তরা পার করছে সাত বছর। জন্ম কতটা অর্থবহ হতে পারে, মৃত্যু কতটা ব্যাথাতুর করতে পারে সুচিত্রা সেন না জন্মালে বোঝা যেত না।

বাংলাদেশের আলো বাতোসে বেড়ে উঠা ষোড়শী সুচিত্রা সেন কলকাতায় পাড়ি জমান ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগেই।

সুন্দর চেহারা আর তার আবেদন টালিগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত করতে বেশি সময় নেয়নি। অথচ এই ইন্ডাষ্ট্রির এক পরিচালক তাকে প্রণয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হলে তার সম্পর্কে বলেছিলেন, দেখব রমা কী করে হিরোইন হয়! যদি হয় তো আমার হাতের তালুতে চুল গড়াবে।

কিন্তু যার আজীবন মানুষের হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার যোগ্যতা আছে তাকে কি দমিয়ে রাখা যাবে? তা যায়নিও তাকে। তারকা হওয়ার পর একদিন সেই পরিচালকের সঙ্গে দেখা সুচিত্রা সেনের। তিনি তো সেই পরিচালককে বলেই বসেছিলেন, দেখি দেখি আপনার হাতটা। হাতের তালুতে চুল গজানোর কথা ছিল তো! আমি তো হিরোইন হয়ে গিয়েছি।

বিয়ের পর নাকি নায়িকাদের কদর কমে যায়! এমন কথাকে বহু আগেই ভুল প্রমাণ করেছিলেন সুচিত্রা। তিনি অভিনয়ে এসেছিলেন বিয়ের পরে। অভিনয় নাকি বাংলার আরেক মহানায়ক উত্তম কুমারে সঙ্গে প্রেম, ঠিক কি কারণে সংসার ভেঙেছিল তা জানা যায়নি। তবে তার ডিভোর্সও হয়নি।

শেঁকড়

শিশু বয়স থেকে নায়িকা জীবন পার করতে বেশ কয়েকটি নামধারণ করতে হয়েছে তাকে। বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জের মামা বাড়িতে জন্ম নেওয়া সুচিত্রার প্রথম নাম ছিল কৃষ্ণা। যদিও তার বেশ কয়েকদিন পর পৈত্রিক বাড়ি পাবনার গোপালপুরে চলে যান। বাবা করুনাময় দাশগুপ্ত ও মা ইন্দিরা দুজনের জেলার সম্মানজনক পদে চাকরি করতেন। পিতামহের দেওয়া কৃষ্ণা নামটি তার বাবা পাল্টে দেন। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে তার নাম হয় রমা দাশগুপ্ত।

সুচিত্রা সেই শৈশব থেকেই ভীষণ স্মার্ট আর আধুনিক ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ, গান ও আবৃত্তি করতেন তিনি। বাংলার গভর্নর জন এন্ডারসনের স্ত্রী পাবনা বালিকা বিদ্যালয়ে এলে তার সম্মানে কৃষ্ণার নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ‘ঋতুরঙ্গ’ মঞ্চস্থ হয়।

১৯৪৭ সালের শুরুর দিকে রমার বড় বোন উমার বিয়ের পর বিশেষ কারণে সুচিত্রার পুরো পরিবার কলকাতায় চলে যায়। বিয়ের পর তার নাম হয় রমা সেন। এরপর সিনেমায় নাম লিখিয়ে রমা সেন থেকে হয়ে ওঠেন সুচিত্রা সেন।

বিয়ে

করুনাময় দাশগুপ্ত বাংলাদেশের পাট চুকিয়ে শান্তিনিকেতনে পরিবার নিয়ে চলে যান। সেখানে কিছুদিন থাকার পর ভুবনডাঙ্গা গ্রামে নিজে বাড়ি তৈরি করেন। তারপর মেরিন ইঞ্জিনিয়ার দিবানাথ সেনের সঙ্গে ১৬ বছর বয়সে রমার বিয়ে হলে আবার কলকাতা শহরে ফিরে আসেন তিনি (রমা)। দিবানাথের পরিবারের আদি বাড়ি ছিল ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। বিয়ের পর রমা দাশগুপ্ত হন রমা সেন। কিন্তু সংসারে তার শান্তি স্থায়ী হয়নি। বিয়ের পর জানতে পারেন তার স্বামীয় বেপরোয়া জীবন।

সিনেমা জীবন স্বামীকে নিয়ে অস্বস্তিতে থাকা রমা মন ঠিকটাক রাখতে এলাকার একটি নাটকের দলের সঙ্গে যুক্ত হন। তাদের প্রযোজনা ‘নটীর পূজা’য় অভিনয় করে সবাইকে মুগ্ধ করেন। এরপর স্বামীর আত্মীয় বিমল রায়ের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে, তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা। পরিবারের অনুমতি নিয়ে বিয়ের আট বছরের মাথায় প্রথম সিনেমা ‘শেষ কোথায়’ এ অভিনয় করেন। এটিই ছিল তার জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’। তবে এ ছবিটি মুক্তি পায়নি। সিনেমাটি মুক্তি না পেলেও ইন্ডাষ্ট্রিতে তার নিয়মিত যাতায়াতের কারণে দ্বিতীয় সিনেমা পেতে দেরি হয়নি। নীতিশ রায়ের ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদি’ সিনেমায় অভিনয় করেন। নীতিশ রায় এ ছবিতে তার নাম দেন সুচিত্রা।

এরপর পিনাকী মুখার্জী পরিচালিত ‘সংকেত’ ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৫২ সালে নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত ‘কাজর’ ছবিতে সুচিত্রা সেন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। অভিনয় করা ছবিগুলো তাকে এগিয়ে দিচ্ছিল ঠিকই কিন্তু তার জীবনকে পাল্টে দেয় ১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’। এতে তিনি বিষ্ণুপ্রিয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

তার জীবনের সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায় শুরু হয়। ১৯৫৩ সালে মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গে তার প্রথম ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ মুক্তি পায়। এই জুটি পরবর্তী সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রে গভীর প্রভাব ফেলে। জুটি হিসেবে তারা অভিনয় করেন ৩০টি ছবিতে।

তারপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। তার অভিনয়, চলন-বলনে সব যুবতীদের কাছে অনুকরণীয় হয়ে উঠেছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন পঞ্চাশ ও ষাট দশকের ফ্যাশন ও স্টাইল আইকন।

উত্তম কুমার ছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অশোক কুমার, বসন্ত চ্যাটার্জীর, রঞ্জিত মল্লিক সহ বেশ কিছু নায়কের সঙ্গে জুটি বেঁধে অসাধারণ কিছু ছবি উপহার দিয়েছেন তিনি।

১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ১৯টি ছবি মুক্তি পায়। ‘শাপ মোচন’, ‘হারানো সুর’, ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘মরনের পরে’, ‘গৃহ প্রবেশ’, ‘পথে হল দেরি’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘সপ্তপদী’, ‘গৃহদাহ’, ‘হার মানা হার’, ‘হসপিটাল’, ‘সাথীহারা’, ‘আলো আমার আলো’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘সাগরিকা’, ‘দত্তা’ প্রভৃতি সিনেমায় সুচিত্রা সেন তার অসাধারণ প্রতিভার সাক্ষর রেখেছিলেন।

১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন ‘সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস” জয় করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।

বোম্বাই (মুম্বই) অভিযান

সুচিত্রা সেন বাংলা সিনেমার পাশাপাশি সেময়ের বোম্বাই অর্থাৎ হিন্দি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ‘দেবদাস’ ছবিতে অভিনয় করেছেন। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি সেই বছর শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন। এরপর তিনি ‘বোম্বাই কা বাবু’ ও ‘সরহদ’ নামে আরও দুটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। গুলজারের পরিচালনায় ‘আঁধি’ ছবিতে তার ইন্দিরা গান্ধী চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বোম্বাইয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন। ‘আঁধি’ ও ‘মমতা’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান।

১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সুচিত্রা আর কোনো ছবিতে কাজ করেননি। এরপর ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ৫টি ছবিতে পুনরায় একসঙ্গে কাজ করেছেন।

২৬ বছরের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ৫৩টি বাংলা ও ৭টি হিন্দি মিলিয়ে মোট ৬০টি ছবিতে কাজ করেন ভারতবর্ষের মহানায়িকা সুচিত্রা সেন।

পুরস্কার

এছাড়াও বাংলা চলচ্চিত্রে সপ্তপদী (১৯৬১), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩), আলো আমার আলো (১৯৭২) ও আধি (হিন্দি) ছবির জন্য বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান। হিন্দি ছবি মমতার জন্য তৃতীয় মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে সেরা অভিনেত্রীর, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী (১৯৭২) ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার (২০১২) অর্জন করেন।

২০০৫ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে দাদা সাহেব ফালকে সম্মাননা ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সুচিত্রা সেন দিল্লি যেতে হবে বলে সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন।

স্মামী দিবানাথে সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ

উত্তম কুমারের সঙ্গে পর্দায় উপস্থিতি কম থাকলেও বাস্তবে তারা প্রণয়ের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, উত্তম কুমারের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্কের কারণে সংসারে ভাঙন ধরেছিল। ১৯৬৩ সাল থেকে সুচিত্রা স্বামী দিবানাথের কাছ থেকে আলাদা হন। তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়নি কখনো। সবশেষ আমেরিকার পাড়ি জমান দিবানাথ।

সুচিত্রা দিবানাথের বালিগঞ্জের বাড়ি ছেড়ে প্রথমে ম্যুর অ্যাভিনিউতে তারপর নিউ আলীপুরে থাকা শুরু করেন। ১৯৬০ সালে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী শচীন চৌধুরীর বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটি কিনে নিজের মতো করে সাজিয়ে নেন সুচিত্রা সেন। ১৯৭৮ সালে “প্রণয় পাশা” মুক্তির পর তিনি চলে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে।

উত্তম-সূচিত্রা রসায়ন

১৯৬১ সালের পর পর্দায় উপস্থিতি না থাকলে ব্যক্তিজীবনে উত্তম-সুচিত্রা খুব কাছাকাছি ছিলেন। তাদের জুটি হিসেবে করা ৩০টি ছবিতে কখনোই তাদেরকে স্বাভাবিক মনে হয়নি। সিনেমাপাড়া থেকে শুরু করে নিজের মেয়ে মুনমুন সেনও জানতেন এই প্রণয়ের কথা।

এ বিষয়ে অবশ্য সত্যজিৎ রায়ের একটি আলোচিত মন্তব্য আছে। সেটি হলো, পৃথিবীতে খুব কম জুড়ি আছে যাদের মধ্যে বন্ডটা এত ম্যাজিকাল। তিনি প্রযোজকদের উত্তমকুমারের উপরে তার নাম লিখতে বাধ্য করেছিলেন। সকলে সেটা মেনেও নিয়েছিল।

উত্তম কুমারের মৃত্যু তাকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয়। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই উত্তম কুমারের মৃত্যু হলে গভীর রাতে প্রিয় মানুষটিতে দেখতে যান ইতিমধ্যে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়া সুচিত্রা।

মৃত্যু

উত্তম কুমারের চলে যাওয়ার পর আরও ৩৪ বছর এভাবেই লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে যান না ফেরার দেশে।

সুচিত্রা সেন চলে গেছেন সাত বছর হয়ে গেল। ১৯৭৮ থেকে আড়াল হওয়া এবং ২০১৪ থেকে একেবারেই চলে যাওয়ার পরও কি সবাই তাকে ভুলতে পেরেছে? সিনেমায় যারা তাকে দেখেছে তারা কি কখনো তাকে ভুলতে পারবে? তার সেই নিখুঁত অভিনয়, মনভোলানো হাসি আর ছন্দময় চলা কিছুতেই ভুলতে পারবে না কেউ। তিনি আজীবন আমাদের মধ্যে থাকবেন চিরসবুজ সুচিত্রা সেন হয়ে।