ঢাকা, শনিবার ২৩, নভেম্বর ২০২৪ ১৬:৩৮:৩০ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
ডেঙ্গুতে এ বছরেই ৫১ শিশুর প্রাণহানি মাকে হত্যা করে থানায় হাজির ছেলে আমদানির সাড়ে তিনগুণ দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে আলু ঢাকায় আয়ারল্যান্ড নারী ক্রিকেট দল সাতক্ষীরায় সাফজয়ী তিন নারী ফুটবলারের গণসংবর্ধনা

মৃত্যুকে তুচ্ছ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অবিচল ছিলেন সৈয়দ নজরুল

নিজস্ব প্রতিবেদক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০১:০০ পিএম, ৩ নভেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম একজন নির্লোভ, দেশপ্রেমিক ও আত্মত্যাগী নেতা হিসেবে আমৃত্যু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত স্বজন ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতাসীন খুনি মোশতাক চক্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করায় তাঁকে কারাজীবন বেছে নিতে হয়। আরো তিন জন সতীর্থের সঙ্গে ৩ নভেম্বর জেলহত্যাকাণ্ডে নৃশংসতার শিকার হয়ে জীবন দিতে হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাসায় ফোন করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। কে কল করেছে বুঝতে না পেরে সৈয়দ নজরুল ফোনটি রিসিভ করেন। এক দুই মুহূর্ত তিনি চুপ করে শোনেন। মোশতাক তাকে লোভ এবং ভয় দেখাতে চেষ্টা করেন রিসিভারের অপর প্রান্ত থেকে। শান্ত স্বভাবের সৈয়দ নজরুল ‘বেঈমান’- বলে হুংকার দিয়ে প্রচন্ড রাগে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং টেলিফোনটাকে সজোরে আছড়ে ফেলেন।

এরপরও একাধিকবার ফোন করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। সৈয়দা নাফিসা ইসলাম ফোন রিসিভ করলে চাইতেন সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। কিন্তু খন্দকার মোশতাকের ফোনই ধরেননি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

সৈয়দা নাফিসা ইসলামকে ফোনে তখন মোশতাক বলেছিলেন, আশরাফের বাপের তো ভয়াবহ পরিণতি হবে। তুমি তাকে বল আমার সাথে যেতে। আর্মিদের আমি কন্ট্রোল করতে পারছি না। আসলে ওর যা প্রাপ্য তার চাইতে বেশি সুযোগ-সুবিধা আমি দিব।

সৈয়দা নাফিসা ইসলামও খন্দকার মোশতাকের প্রলোভন-হুমকি উপেক্ষা করেন। মোশতাকের ফোন আর প্রলোভনের কথা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে জানানোর পর স্ত্রী সৈয়দা নাফিসা ইসলামকে তিনি বলেছিলেন, যারা বঙ্গবন্ধুসহ সারা পরিবারকে মেরে ফেলেছে। তাদের সাথে কোন কথা হতে পারে না। আমি বঙ্গবন্ধুর রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।

খন্দকার মোশতাকের ডাক উপেক্ষা করায় ২৩ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় চার নেতাকে। জেলখানায়ও অনেক প্রলোভন দেখানো হয় সৈয়দ নজরুলকে, দেয়া হয় মৃত্যুর হুমকি। কিন্তু শত প্রলোভনেও তিনি মাথা নত করেননি। মৃত্যুকে তুচ্ছ ভেবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি অবিচল ছিলেন তিনি। যতবার প্রলোভন এসেছে, প্রস্তাব এসেছে, প্রত্যেকবার তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

আটকের ২ মাস ১১দিন পর ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সেদিন মধ্যরাতে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে বন্দি থাকা অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে।

নির্মম সে হত্যাযজ্ঞের আগে-পরে সেই সময়ের দুঃসহ নানা স্মৃতির কথা বলেছেন শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে কিশোরগঞ্জ-১ (সদর-হোসেনপুর) আসনের সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি। পুতুল খেলার বয়সে বাবার মর্মান্তিক মৃত্যু ও শূণ্যতা স্মৃতিকাতর জাকিয়া নূর লিপিকে সবসময় কাঁদায়। কোমল হৃদয়ের বাবার আত্মত্যাগের সেই স্মৃতি আজো তাঁর চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসে।

বাকরুদ্ধ কণ্ঠে সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি এমপি জানান, ওই সময় তিনি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জাতীয় চার নেতাসহ সৈয়দ নজরুলকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন সৈয়দা নাফিসা ইসলাম সরকারি বাসভবন ছেড়ে গোপীবাগে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে ওঠেন।

সেই বাসায় মায়ের আঁচল ঘিরে থাকতেন অবুঝ তিন ভাই-বোন সৈয়দ শরীফুল ইসলাম, সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি ও সৈয়দা রাফিয়া নূর রূপা। সেই বাসা থেকেই সৈয়দা নাফিসা ইসলাম প্রতিদিন রান্না করে সৈয়দ নজরুলের জন্য কেন্দ্রীয় কারাগারে খাবার পাঠাতেন।

এরই মাঝে ৩রা নভেম্বর ঘটে মর্মন্তুদ জেলহত্যার ঘটনা। তখন সৈয়দ নজরুল ইসলামের চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও ছোট ছেলে সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম দেশের বাইরে এবং সৈয়দ শাফায়েতুল ইসলাম বিএমএ-র ট্রেনিংয়ে চট্টগ্রামে।

নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞের পর অবুঝ ছেলে সৈয়দ শরীফুল ইসলামকে সাথে নিয়ে সৈয়দা নাফিসা ইসলাম কারাগারে যান সৈয়দ নজরুল ইসলামের লাশ আনতে। কিন্তু সৈয়দ শরীফুল ইসলাম প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ায় লাশ সনাক্ত করতে দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ। পরে সৈয়দা নাফিসা ইসলামের ভাই আসাদুজ্জামান গিয়ে লাশ সনাক্ত করেন।

আসাদুজ্জামানের বাসায় লাশ আনার পর আরমানিটোলা মাঠে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাফন করার সিদ্দান্ত নেয়া হলেও জানাজার পর পরই একটি পিকআপে করে একদল সেনাসদস্য এসে জোর করে অত্যন্ত অসম্মানজনকভাবে লাশ নিয়ে গিয়ে তারা বনানী কবরস্থানে দাফন করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাত্র আড়াই মাস পর জেলহত্যার এ ঘটনায় পুরো দেশ স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। নৃশংস এই ঘটনার আগে তারা বুঝতেই পারেন নি, এভাবে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হতে পারে।

সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি বলেন, বাবার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর আমাদের মা আমাদের নিয়ে পাথরচাপা কষ্টে শোক সামলেছেন। সে সময় আমাদের সমবেদনা জানানোর মতোও কেউ ছিল না। আমাদের নিয়ে মাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। মায়ের নিরন্তর সংগ্রামের কারণে আমরা আজ এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি।

বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্থ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্ম কিশোরগঞ্জ শহরের ৩ কিলোমিটার পূর্বে যশোদল ইউনিয়নের ছায়া সুনিবিড় নিভৃত পল্লী বীরদামপাড়া গ্রামে ১৯২৫ সালে। তার বাবার নাম সৈয়দ আব্দুর রইস এবং মা সৈয়দা নূরুন্নাহার খাতুন। সরকারি চাকুরে বাবা এলাকায় রইস মিয়া সাহেব নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। ‘সাহেব বাড়ি’ নামে ওই বাড়িটির খ্যাতি আজও বর্তমান।

তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় বোন সৈয়দা আনোয়ারা ইসলাম, মধ্যম সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ছোট সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম। সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাল্যকালের ডাকনাম ছিল ‘গোলাপ’।

কিশোরগঞ্জে তার বাল্যশিক্ষা শুরু হয়। পরে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল এবং আনন্দমোহন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে যথাক্রমে প্রবেশিকা ও আইএ পরীক্ষা পাস করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে এমএ এবং ১৯৫৩ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৪৯ সালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম পাকিস্তান সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর বিভাগে অফিসার পদে যোগদান করেন। কিন্তু আরও বৃহৎ কর্মযজ্ঞ যার জন্য অপেক্ষা করছে, তিনি সাধারণ একটি সরকারি চাকুরিতে সন্তুষ্ট থাকবেন কেন? দুই বছরের মধ্যে চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে আনন্দমোহন কলেজে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন।

কিছুদিন পর এ পেশা ছেড়ে আইন ব্যবসায় এবং রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছাত্রজীবনেই রাজনীতি ও দেশ সেবার মন্ত্রে উজ্জীবিত হন। ১৯৪৬-১৯৪৭ সালে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনের সময় গঠিত সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটির সদস্য হিসেবে ভাষা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৫৭ সালে খ্যাতিমান রাজনীতিক, সুসাহিত্যিক ও পাকিস্তানের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমেদকে কাউন্সিলের মাধ্যমে হারিয়ে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৪ সালে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে সমাসীন ছিলেন।

বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা প্রণীত হবার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে বার বার কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। দিনে দিনে স্বাধিকার আন্দোলন প্রবলভাবে বেগবান হতে থাকে। ওই সঙ্কটময় সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দলের সভাপতির (১৯৬৬-১৯৬৯) গুরুদায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের উপনেতা নির্বাচিত করা হয়।

সৈয়দ নজরুল ইসলামের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সৈয়দ নজরুল ইসলাম তা রক্ষা করে গেছেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পর গোটা জাতি এক ভয়াবহ সঙ্কটে নিপতিত হয়।

শুরু হয় গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ। মুজিবনগরে গঠন করা হয় অস্থায়ী সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি আর সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হয় ওই সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুলের কাঁধেই বর্তায় মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রবাসী সরকার পরিচালনার দায়িত্বভার।

কারামুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে ফিরে আসার পর সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু হলে নতুন সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী হন সৈয়দ নজরুল। ১৯৭৩ সালে নতুন সরকার গঠিত হলে তিনি একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি দেশে সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা চালু করা হলে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম হন উপ-রাষ্ট্রপতি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্যের হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়। খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হয়ে পুরানো সহকর্মীদের কয়েকজনকে তার মন্ত্রণালয়ে অন্তর্ভুক্ত করেন।

কিন্তু সৈয়দ নজরুলসহ জাতীয় ৪ নেতা তার মন্ত্রীসভায় যোগদানে অস্বীকৃতি জানালে ২৩ আগস্ট তাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে বন্দি করা হয়। ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় ৪ নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাত্র আড়াই মাস পর জেলহত্যার এ ঘটনায় পুরো দেশ স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। নৃশংস এই ঘটনার আগে দেশবাসী বুঝতেই পারেনি, এভাবে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হতে পারে।


-জেডসি