ঢাকা, বৃহস্পতিবার ৩০, জানুয়ারি ২০২৫ ২০:০৯:১৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ বন্ধ হচ্ছে ৯ মাসের জন্য আরও ১৫ দিন বাড়ছে রিটার্ন জমার সময় নারী ফুটবল ম্যাচ আয়োজনে বাধা: বাফুফের প্রতিবাদ যুক্তরাষ্ট্রে হেলিকপ্টার-বিমান সংঘর্ষ, ১৮ মরদেহ উদ্ধার শিশুসহ ১১০ ফিলিস্তিনি মুক্তি পাচ্ছেন আজ আবারও কমল পঞ্চগড়ের তাপমাত্রা, রেকর্ড ৯.৫ ডিগ্রি বাংলা একাডেমি পুরস্কারের তালিকা পুনঃপ্রকাশ

রবি ঠাকুরের ‘নতুন বৌঠান’ এবং প্রসঙ্গ কথা

উন্মে হানি | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৩:৩২ পিএম, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ বুধবার

ফাইল ছবি।

ফাইল ছবি।

‘চেয়ে তব মুখপানে বসে এই ঠাঁই/প্রতিদিন যত গান তোমারে শোনাই/বুঝিতে কি পার সখি, কেন যে তা গাই?/বুঝো নাকি হৃদয়ের কোন খানে সেল ফোটে/তব প্রতি কথাগুলো আর্তনাদ করে ওঠে...’।  (সন্ধ্যাসঙ্গীত- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ গান ছিল তার নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীকে উদ্দেশ্য করে লেখা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তি জীবনের কথা বলতে গেলে যে রহস্যময়ী নারীর প্রসঙ্গ উঠে আসে তিনি হলেন কাদম্বরী দেবী। রবি ঠাকুরের বড় দাদা জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী। ১৮৫৯ সালের ৫ জুলাই কলকাতায় কাদম্বরী দেবীর জন্ম। কাদম্বরী দেবী ছিলেন ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকারের তৃতীয় কন্যা। নয় বছর বয়সে ১৯ বছর বয়সী যতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে কাদম্বরী দেবীর বিয়ে হয়। আসলে শুভ পরিণয় হলেও শেষ পর্যন্ত সে সম্পর্কের শুভ পরিনতি হয়নি।

কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থেকে দু বছরের বড় ছিলেন। কাছাকাছি বয়সের এই দুই মানব-মানবীর মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে রয়েছে অনেক ধোঁয়াশা, জটিলতা, বিতর্ক ও মুখরোচক গল্প। তবে তাদের এই সম্পর্ক যতটা না বিশ্লেষণ করা জরুরি তার চেয়েও অধিক অনুভব করা দরকার।সমবয়সী হওয়ার কারণে তারা দুজনই খুব ভালো বন্ধু এবং সহপাঠীও ছিলেন। যার কারণে দুজনের সম্পর্ক নিয়ে গড়ে ওঠা বিতর্ক বা গল্পগুলো এখনও রয়ে গেছে ।

কাদম্বরী দেবী ছিলেন শিক্ষিত ও একাধারে নানা গুণে গুণান্বিত। বিয়ের পর যতীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন । তার পিতামহ জগমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে রবি ঠাকুর ও কাদম্বরী গান শিখেছিলেন। কাদম্বরী তার সৃষ্টিশীল মতামতের মাধ্যমে রবি ঠাকুরের বিভিন্ন গল্প-কবিতা, নাটক আর গান রচনাতে উৎসাহ যোগাতেন। তাছাড়া ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের যা-কিছু সুন্দর তার সব কিছুর সাথে জড়িয়ে আছেন কাদম্বরী। ঠাকুর বাড়ির ছাদে গড়ে তুলেছিলেন ‘নন্দনকানন’।

তিনি একজন সুঅভিনেত্রী ছিলেন। যতীন্দ্রনাথের লেখা প্রহসন ‘এমন কর্ম আর করব না’ তে প্রথম অভিনয় করেছিলেন কাদম্বরী। এতে নায়কের ভূমিকায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এর পরে তিনি ‘বসন্ত উৎসব’ এবং ‘মানময়ী’ নাটকে অভিনয় করেন।
কাদম্বরী দেবীর ছিল বইয়ের নেশা। তবে নিজে পড়ার চেয়ে শুনতে ভালোবাসতেন বেশি। দুপুরে রবীন্দ্রনাথ বই পড়ে শুনাতেন তার নতুন বৌঠানকে। এ সময় রবীকে পাশ থেকে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতেন কাদম্বরী। রবীন্দ্রনাথের কবি হয়ে ওঠার পেছনে কাদম্বরীর অবদান ছিল অনেক।

রবি ঠাকুরের বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। তার আকস্মিক মৃত্যু হলেও অনেকের কাছে তা অপ্রত্যাশিত ছিলো না । গবেষকদের মতে, কাদম্বরী ছিলেন প্রচন্ড ‘ইন্ট্রোভার্ট ও সেন্টিমেন্টাল’। কথিত আছে, একবার তিনি ছাঁদ থেকে পড়তে পড়তে বেঁচে যান। নতুন বৌঠানকে রবি ঠাকুরই সেদিন বাঁচিয়েছিলেন ।

এছাড়া কাদম্বরীদেবীর আত্মহত্যার পেছনে বেশ কিছু কারণকে দায়ী করা হয়। অন্তঃপুরে মহিলাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের আধিক্য, জ্ঞানদানন্দিনীর সাথেই ছিল তার প্রবল মতান্তর। রবি ঠাকুরের দিদি স্বর্ণকুমারীর মেয়ে উর্মিলাকে খুব স্নেহ করতেন নিঃসন্তান কাদম্বরী। হঠাৎ ছোট শিশু উর্মিলা একদিন সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা গেলে সব রোষানল এসে পড়ে কাদম্বরীর ওপর। তাকে দায়ী করা হয়। যা কাদম্বরীর হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেছিল।
এছাড়া নিজের পিতা ঠাকুরবাড়ির এক সামান্য কর্মচারি এবং দাদু দারোয়ান ছিলেন বলে ঠাকুরবাড়ির অনেকেই তাকে নিচু চোখে দেখতেন।
কাদম্বরী দেবীর মত শিক্ষিত রুচিশীল নারীর জীবনে শান্তি ছিল না। সন্তান না থাকার কারণে সে ছিল তাচ্ছিল্যের পাত্রী। একসময় একাকীত্ব ভুলতে তিনি আফিম নেওয়া শুরু করেছিলেন। 
অন্যদিকে স্বামীর নাটক, থিয়েটার নিয়ে ব্যস্ততা থাকা, রাতে বাড়ি না ফেরাসহ নানা কারণে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। স্বামীর সঙ্গে সে সময়ের অভিনেত্রী বিনোদিনীর পরকীয়ার সম্পর্ক তাকে আরো যন্ত্রণা এবং অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। 
রবি ঠাকুরের বিয়ের পর তার সাথে রবি ঠাকুরের দূরত্ব বেড়ে যায়, যা তাকে নিঃসঙ্গ করে তোলে।

সে সময়ে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু ছিল কলকাতার সমাজের অন্যতম আলোচিত বিষয়। যদিও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হস্তক্ষেপে তার মৃত্যুর ঘটনাটি প্রকাশ পায়নি। এমনকি তার লাশ মর্গেও পাঠানো হয়নি। কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড-নোটটি কর্পূরের মত নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছিল। তবে তখন তার মৃত্যুর সবচেয়ে জোরালো কারণ ছিল রবি ঠাকুরের সাথে কাদম্বরী দেবীর প্রেমের বিষয়টি।

একথা সত্য যে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু রবি ঠাকুরকে বেশ আহত করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর অনেকদিন পর্যন্ত রবি ঠাকুর নতুন বৌঠানের অভাব অনুভব করতেন। কাদম্বরীর মৃত্যুর পূর্বে যেমন রবি ঠাকুরের সব বই প্রথমে উৎসর্গ হত কাদম্বরীর নামে, মৃত্যুর পরও এ ধারা অব্যাহত ছিল।

কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর সাতদিন পর রবি ঠাকুরের বই ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ বের হয়। উৎসর্গ পত্রে লেখা ছিল ‘শুধু তোমাকে দিলাম’। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ তার নতুন বৌঠানকে নিয়ে লিখেন ‘নষ্টনীড়’। কাদম্বরী আত্মহত্যা করার পর রবি ঠাকুর গেয়েছিলেন ‘মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে’। কারণ আত্মহত্যা করার আগে কাদম্বরী রবি ঠাকুরের ঘরে এসে মুচকি হেসে চলে গিয়েছিলেন। তার অনেক কবিতা ও গানে কাদম্বরীর ছায়া পাওয়া যায়।

কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর চার বছর পর কবি ‘তবু মনে রেখো’ গানটি লেখেন তাকে উদ্দেশ্য করে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাবলীতে যেসব নারী চরিত্র এসেছে তাতে কাদম্বরী দেবীর ছায়া লক্ষনীয় ।

অনেক অনেক লেখা আছে রবি কাদম্বরীকে নিয়ে। যেমন: কাল্পনিক সুইসাইড-নোট নিয়েও লেখা হয়েছিল গল্প এবং ১৯৬৪ সালে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চারুলতা ফিল্ম তৈরি হয়েছিল নষ্টনীড় অবলম্বনে । ২০১৫ সালে সুমন ঘোষ পরিচালিত কঙ্কনা সেন শর্মা এবং পরমব্রত চ্যাটার্জী অভিনীত ‘কাদম্বরী’ নামের সিনেমা মুক্তি পায়।

আসলে, রবি ঠাকুরের জীবনে তার নতুন বৌঠান এবং কাদম্বরীর জীবনে রবি ঠাকুরের স্থান ঠিক কি তার সঠিক ব্যাখ্যা শুধু তারাই জানতেন। ‘প্রেম’ শব্দ দিয়ে তাদের সম্পর্কের সঠিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায় না। কারণ ‘প্রেম’ ব্যতীত একটা মানবের সাথে অন্য একটা মানবীর স্নেহ, অনুপ্রেরণা, নির্ভরতা, সম্মান ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। তাই তো অন্য মানুষের সে সম্পর্কের সঠিক তল বা ব্যাখ্যা খুজেঁ পাওয়া কঠিন ব্যাপার।