ঢাকা, শুক্রবার ২২, নভেম্বর ২০২৪ ১৭:২০:৩৮ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
সাতক্ষীরায় সাফজয়ী তিন নারী ফুটবলারের গণসংবর্ধনা দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পঞ্চগড়ে, বাড়ছে শীতের তীব্রতা পেঁয়াজ-সবজি-মুরগির দাম কমলেও আলুর দাম বাড়তি রাজধানীতে মা-মেয়েকে এসিড নিক্ষেপ করে ছিনতাই মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আজ

রোজা লুক্সেমবার্গের নির্বাচিত রচনা: অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী

(ভূমিকা: পিটার হুদিস এবং কেভিন বি. এন্ডারসন)  | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:৫৮ পিএম, ৬ এপ্রিল ২০২২ বুধবার

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

ভূমিকা/পর্ব-৬: সাম্প্রতিক সময়ে রুশ বিপ্লব প্রসঙ্গে রোজার সমালোচনা নিয়ে এক নতুন পুরাণ উদ্ভুত হয়েছে। আর সেটা হল খোদ লেনিনের ‘সাহসে’র বিরুদ্ধে গিয়ে (যে লেনিন কিনা উদ্দেশ্যমূলক প্রতিবন্ধকতাসমূহ লাফ দিয়ে পার হয়ে ‘বৈপ্লবিক ঘটনাসমূহ’-এর প্রচার করেছেন) রোজার সমালোচনা মূলত: ঐতিহাসিক উদ্যোগগুলো বাজেয়াপ্ত করা প্রসঙ্গে লুক্সেমবার্গের অনীহাকেই প্রকাশ করে। কিন্ত সত্য থেকে এর চেয়ে দূরবর্তী আর কোন বক্তব্যই হতে পারে না। লুক্সেমবার্গ অক্টোবর বিপ্লবের বিরোধিতা করেননি। ক্ষমতা দখলের প্রয়োজন প্রশ্নে তিনি লাজুকও ছিলেন না। বার্ণস্টেইনের সমালোচনা করা থেকে ১৯১৮-১৯ সালের জার্মান বিপ্লবে তাঁর অংশগ্রহণ- তাঁর প্রতিটি কাজ ও আচরণ থেকেই রোজার বৈপ্লবিক সুস্পষ্টতা বোঝা যায়। তাঁর জন্য মূল সমস্যা ছিল ক্ষমতা দখলের চরিত্রটি বোঝা এবং বিস্তৃততম সম্ভাব্য বৈপ্লবিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে সে বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা করা। যেমনটা তিনি লিখেছেন `‌‌দ্য রাশিয়ান রেভল্যুশনে’:

                 সর্বহারারা যখন ক্ষমতা দখল করে, তখন তারা পুনরায় কাউতস্কির এই সুপরামর্শ আর কখনোই মেনে চলতে পারে না যে ‘দেশ এখনো বিপ্লবের জন্য পরিপূর্ণ পক্ক নয়’ আপ্তবাক্যটির তরে  দেশের সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের কাজ প্রয়োগ করা বন্ধ করে দেবে...সত্যি বলতে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের কাজ বরং যত দ্রুত সম্ভব সবচেয়ে বেশি শক্তি নিয়ে শুরু হওয়া উচিত, সবচেয়ে বেশি অনমনীয় এবং নির্মম পন্থায় শুরু হতে হবে এই পরিবর্তনের কাজ। অন্য কথায় বললে, সর্বহারারা অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করবে একনায়কত্ব, তবে এই একনায়কত্ব হবে শ্রেণীর একনায়কত্ব, কোন দল বা উপদলের একনায়কত্ব নয়- এবং শ্রেণীর একনায়কত্ব অর্থ হচ্ছে: এক নি:সীম গণতন্ত্রে বিস্তৃততম জনতার পূর্ণ দৃষ্টিতে সবচেয়ে সক্রিয়, কুণ্ঠাহীণ ভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

লুক্সেমবার্গের জন্য “ক্ষমতায় যাবার পর প্রলেতারিয়েতের ঐতিহাসিক কাজ হল  বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, কিন্ত তাই বলে গণতন্ত্র জিনিষটাই উড়িয়ে ফেলা তার কাজ নয়।’ এর চেয়ে কম কোন কিছুতেই লুক্সেমবার্গ রাজি হবেন না যেহেতু ‘সমাজতান্ত্রিক অনুশীলন বলতে বোঝায় জনতার এক সম্পূর্ণ আত্মিক রূপান্তর যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বুর্জোয়া শ্রেণী শাসনের দ্বারা অধ:পতিত হয়েছে।’      

৫.
জার্মানীতে ১৯১৮-১৯ সালে যে প্রকৃত বৈপ্লবিক প্রক্রিয়া শুরু হয়, সেখানে লুক্সেমবার্গ উপরোক্ত ভাবনাসমূহ পরীক্ষা করার প্রত্যক্ষ সুযোগ পান। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পতনের পর ১৯১৪-এর ৪ঠা আগস্ট নাগাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে এসপিডি যখন যুদ্ধ ঋৃণের পক্ষে ভোট দান করে, তখনি এই বিপ্লবী সব ধ্যান-ধারণাকে কাজে লাগানোর জন্য একটি উদ্যোগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পতন এই উদ্যোগ প্রক্রিয়াকে গতি দেয়। আহত হৃদয় এবং এসপিডির এই প্রবল প্রতারণার মুখে শুরুতে আত্মহত্যার মত মানসিক অবস্থা হলেও  ভেঙ্গে পড়লেও দ্রুতই রোজা নিজেকে পুনর্বিন্যস্ত করেন এবং সা¤্রাজ্যবাদী যুদ্ধের কাছে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের এই আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে একটি বৈপ্লবিক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। ৪ঠা আগস্টের সন্ধ্যায়, এসপিডির প্রতারণা থেকে সমাজতন্ত্রকে বিচ্ছিন্ন করার কৌশলগুলো ছকে ফেলবার রক্ষ্যে রোজা তাঁর এ্যাপার্টমেন্টে সহকর্মীদের সাথে মিলিত হন। দ্রুতই তাঁর সাথে একাজে যোগ দেন কার্ল লিবেনিখট যিনি কিনা ছিলেন রাইখস্ট্যাগ তথা জার্মান সংসদের একমাত্র ডেপুটি যিনি প্রকাশ্যে যুদ্ধ দেনার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি এই বিরোধিতা করেন ১৯১৪ সালের শেষ নাগাদ। ১৯১৫ সালের শুরুর দিকে, লুক্সেমবার্গ, লিবেনিখট ও আরো কয়েকজন মিলে গঠন করলেন ‘দাই গ্রুপ্পে ইন্টারন্যাশনাল’ এবং ‘দাই ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। যদিও যুদ্ধকালীন সেন্সরশীপের জন্য পত্রিকাটির পরবর্তী কোন সংখ্যার প্রকাশনা নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তবু এই পত্রিকার একটি মাত্র সংখ্যাই যুদ্ধবিরোধী আবেগকে বহগুণে বাড়াতে সক্ষম হয় এবং আরো এক বছর পর লুক্সেমবার্গ ও লিবেনেখটের পরিচালনায় ‘স্পার্টাকাস গ্রুপ’ গঠিত হয়।

ইতোমধ্যে লুক্সেমবার্গ একবার জেলেও গেছিলেন। কারাগার থেকে লেখা তাঁর চিঠিগুলোয় তিনি তাঁর বহুমুখী ব্যক্তিত্বের এবং মেধাগত নানা আগ্রহের জায়গার স্বাক্ষর রাখেন। করোলেঙ্কোর রচনাবলীর উপর এসময়ে লেখা রোজার একটি প্রবন্ধ থেকে বোঝা যায় যে গভীর আগ্রহে তিনি রুশ সাহিত্য পড়েছেন, মন্তব্য করছেন জার্মান রোমান্টিক সাহিত্য এবং ফরাসী কবিতা নিয়ে আর এই কারান্তরীণ সময়েই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করছেন তিনি- লিখছেন ‘দ্য এ্যাকুমুলেশন অফ ক্যাপিটাল: এ্যান এন্টি-ক্রিটিক”- এবং যেমনটা আমরা দেখেছি যে সেই একই সময়ে তিনি ‘ইন্ট্রোডাকশন টু পলিটিক্যাল ইকোনমি’ প্রকাশের জন্যও পান্ডুলিপি চূড়ান্ত ঘষা-মাজা করছেন। মানুষটিই এমন ছিলেন তিনি। জীবনের কঠিনতম মূহুর্তেও কখনো নিজেকে সীমিত বা দমিত হতে দেননি। জেলখানা থেকে বন্ধু ল্যুইস কাউতস্কিকে লেখা একটি চিঠিতে জানাচ্ছেন: ‘আমার কাছে যে বা যারাই চিঠি লেখে, তাদের প্রত্যেকের চিঠিতেই আমি পাই আর্তি ও হাহাকার...যুগযন্ত্রণার দায় মেটাতে কোন ব্যক্তির পুরোপুরি আত্ম-বিসর্জন যেন অনেকের কাছেই দূর্বোধ্য ও অসহনীয় এক বিষয়...একজন রাজনৈতিক যোদ্ধাকে সবকিছুর উপরে ওঠার মানসিকতা সম্পন্ন হতে হবে; নয়তো তুচ্ছ নানা বিষয়ে তিনি কাণের গোড়া অব্দি ডুবে যাবেন।’    

এবং এই কারাগারেই, ১৯১৫ সালে, রোজা রচনা করেন তাঁর যুদ্ধবিরোধী এবং সামরিকায়ণবাদবিরোধী বড় মেনিফেস্টো বা ইশতেহার- ‘দ্য ক্রাইসিস ইন জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেসি,’ – জুনিয়াস ছদ্মনামে লেখাটি প্রকাশিত হয় এবং সেই থেকে জুনিয়াস ইশতেহার নামে এটি পরিচিত। জেল থেকে কোনমতে বাইরে চালান করা এই ইশতেহার ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয় এবং এই ইশতেহারে এসপিডির কঠোর সমালোচনা করা হয়। এই ইশতেহারের পাশাপাশি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকও বৈপ্লবিক পুনর্বিন্যাসের কাজে এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবু এসপিডি থেকে পুরোপুরি সাংগঠনিক বিরতি নেবার জন্য অনেক আহ্বান আবার রোজা প্রত্যাখ্যান করেন। এর আগে, ১৯০৮ সালে, ডাচ নারী বিপ্লবী অঁরিয়েত্তা হোঁলা-হোলস্ট যখন ডাচ সোশ্যাল-ডেমোক্রেটিক পার্টি ছেড়ে দেন, তখন রোজা এর বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ‘শ্রমিক শ্রেণীর মন্দতম দলটিও অন্য যে কোন দলের চেয়ে ভাল।’  একটি একীভূত সংগঠনের আসক্তি, যা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মার্ক্সবাদীদের চারিত্র্য এতটাই চিহ্নিত করেছিল যে লুক্সেমবার্গের উপরেও এর প্রভাব পড়েছিল। জুনিয়াস ইশতেহার ও অন্যান্য লেখায় এসপিডির সমালোচনা সত্ত্বেও, তিনি এসপিডির ভেতর থেকে কাজ করার পক্ষেই যুক্তি প্রদর্শন করতে থাকেন। স্বপক্ষের যুক্তি হিসেবে তাঁর বক্তব্য ছিল যে কর্তৃত্ববাদের প্রতি বিরোধিতামূলক প্রবণতা হিসেবেও এসপিডির ভেতর থেকেই কাজ করে যাওয়া উচিত যেন রাজনীতিবিদেরা কিছুতেই গণসম্পৃক্ততা না হারায়।

১৯১৬ সাল নাগাদ শ্রমিক শ্রেণীর ভেতর যুদ্ধের প্রতি বিরোধিতা তৈরি হচ্ছিল যার প্রতিফলন পাওয়া যায় বার্লিন, ব্রেমেন, ব্রোনশ্চউইগ, স্টুটগার্ট এবং হামবুর্গের বিভিন্ন উতপাদন কারখানায়। এসব শ্রমিকদের  ভেতর কিছু সংখ্যক ছিলেন স্পার্টাকাস গোষ্ঠির সাথে সংযুক্ত, অন্যরা ছিলেন না; বিভিন্ন কারখানায় গড়ে ওঠা এসব ছোট ছোট শ্রমিক বাহিনীর অনেকেই এসপিডির রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এবং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক থেকে দ্রুত মুক্তি চাইছিল। লুক্সেমবার্গ ও লিবেনিখট যখন জেলে, তখন স্পার্টাকাস লীগের আন্ডারগ্রাউন্ড অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার জন্য জরুরি সাংগঠনিকসৃ কাজ নির্বাহের দায়িত্ব লিও য়োগিচেশেসের কাঁধে বর্তায়। ষঢ়যন্ত্রমূলক কাজে লিওর অসাধারণ দক্ষতার জন্য, স্পার্টাকাস গোষ্ঠি সরকারী নানা রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রচুর যুদ্ধবিরোধী ইশতেহার বিতরণে সক্ষম হয়। এসব ইশতেহারের অনেকগুলোই রোজার রচনা। এর ফলেই ১৯১৮ সালে দশ লক্ষ শ্রমিকের অংশগ্রহণে ‘শান্তির জন্য ধর্মঘট’ সৃষ্টির আবহ তৈরি হয়। এই বিক্ষোভ ১৯১৮ সালের জানুয়ারি মাসে জার্মান বিপ্লবের ‘জেনারেলপ্রোব (পোশাকমহড়া)’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯১৭ সালে, এসপিডির বিরোধিতার পর, এসপিডির ভেতরের যে বিরোধী অংশগুলো হুগো হাস এবং গিয়র্গ লেবেড্যুরকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হচ্ছিল, তারা বহিষ্কৃত হয় এবং নিজেদের স্বতন্ত্র ও স্বাধীণ ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (ইউএসপিডি)’ গঠন করে। স্পার্টাকাস গোষ্ঠি নিজেদের ইউএসপিডির সাথে একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রবণতা হিসেবে সম্পৃক্ত করে এবং ইউএসপিডির সীমিত সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে একটি বৈপ্লবিক আঙ্গিকে পরিচালনা করার চেষ্টা করে।

শেষাবধি ১৯১৮ সালের অক্টোবরে কিয়েলে জার্মান নাবিকদের বিদ্রোহের পরপরই জার্মান ফ্রন্ট যুদ্ধে বিধ্বস্ত ও পরাজিত হল। তখনি সূচিত হল জার্মান বিপ্লব। শ্রমিক ও সৈন্যদের পরিষদসমূহ গঠিত হওয়া শুরু হল এবং লিবেনিখটের মত রাজনৈতিক কারাবন্দীরা মুক্ত হল। নভেম্বরের আট তারিখে লুক্সেমবার্গ মুক্তি পেলেন। বিপুল গণঅভ্যুত্থানে শঙ্কিত হয়ে, যুদ্ধকালীন সময়ের শেষ চ্যান্সেলর ম্যাক্স ভন বাডেন, কাইজারের পদত্যাগ ঘোষণা করলেন এবং এসপিডির নেতা ফ্রেডেরিখ এবের্টকে চ্যান্সেলর হিসেবে নিযুক্ত করলেন। এসপিডির দুই নেতা ফিলিপ শেইডেম্যান এবং এবার্ট- যিনি কিনা এহেন সমাজতন্ত্রী ছিলেন যে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমি নশ্বর পাপের মত বিপ্লবকে ঘৃণা করি’-  বুর্জোয়া সীমারেখার ভেতরেই শ্রমিক ও সৈন্যদের বিদ্রোহকে ধারণ করার লক্ষ্যে তাদের শক্তিকে পরিচালিত করেন।

এদিকে  দীর্ঘ কারাবাস রোজা লুক্সেমবার্গের স্বাস্থ্যের উপর কতটা প্রভাব ফেলেছিল তা’ তিনি জেলখানা থেকে ছাড়া পাবার পরপরই তাঁর সহযোদ্ধাদের চোখে ধরা পড়ে। তবু পরবর্তী দু’মাসের ভেতরেই তিনি যথেষ্ট শক্তি এবং সৃজনশীলতার পরিচয় দেখান যখন কিনা সমাজ বিপ্লব সঙ্ঘটনের কাজে নিজেকে তিনি ডুবিয়ে ফেলেন। স্পার্টাকাস লীগের প্রকাশনা ‘দাই রোট ফাহনে’ প্রকাশের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি যা দিনে একবার বা কখনো কখনো দু’বারও প্রকাশিত হত; লুক্সেমবার্গ সাধারণত: প্রতিটি সংখ্যার প্রায় অর্দ্ধেক অংশেরও বেশি জুড়ে লিখতেন। বার্লিন ইউএসপিডির সাথে, বৈপ্লবিক দোকান পরিচালক সমিতি এবং শ্রমিক আর সৈন্যদের সাথে প্রচুর আলাপ-আলোচনা করে ও বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে লাগলেন তিনি। সেই ডিসেম্বরে লুক্সেমবার্গ লিখলেন: ‘বর্তমান বিপ্লবে পুরণো ব্যবস্থার রক্ষকরা শাসক শ্রেণীর ঢাল এবং জাতীয় প্রতীক নিয়ে তালিকাভুক্ত হবে না, বরং তারা আসবে ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি’র ব্যানারের নিচে।’   

এই সঙ্কলণটি ১৯১৮-১৯ সালের জার্মান বিপ্লবের উপর রোজা লুক্সেমবার্গ রচিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখার সন্নিবেশ। আমাদের এই সঙ্কলণে রয়েছে নভেম্বর ১৮, ১৯১৮ বিষয়ে লেখা নিবন্ধ ‘সূচনা (দ্য বিগিনিং)’ যা কিনা রাষ্ট্র বিপ্লবের একটি মূল্যায়ণ করেছে, ‘সমাজের সামাজিকীকরণ (দ্য সোশ্যালাইজেশন অফ সোসাইটি- ডিসেম্বর ৪, ১৯১৮)’ যা কিনা ছিল পুঁজিবাদ উত্তর সমাজ বিষয়ে রোজার পূর্ণতম আলোচনাগুলোর একটি, ‘হোয়াট ডাজ দ্য স্পার্টাকাস লীগ ওয়ন্ট? (ডিসেম্বর ১৪,১৯১৮)’ এবং ‘আমাদের কর্মসূচী ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি (আওয়ার প্রোগ্রাম এ্যান্ড দ্য পলিটিক্যাল সিচুয়েশন) যা কিনা ছিল মূলত: ১৯১৮-এর ৩১ শে ডিসেম্বর তারিখে ‘জার্মান কম্যুনিস্ট পার্টি (কেপিডি)’-র প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে রোজার দেয়া বক্তৃতা। শেষোক্ত বক্তৃতাটি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক থেকে শুধু সাংগঠনিক নয়, তাত্ত্বিক বিচ্ছেদও প্রমাণ করে। এই বক্তৃতায় রোজা নিজেকে শুধুই এসপিডি নেতাদের সমালোচনায় ব্যস্ত রাখেননি, বরং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের জন্মলগ্ন থেকে যে রাজনীতি অনুসরণ করা হয়েছিল তার সাথে ১৯১৪-এর প্রতারণাকেও তিনি সংযুক্ত করেন, যখন কিনা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ‘ন্যূণতম’ ও ‘সর্বোচ্চ’ দাবিদাওয়ার পার্থক্য সমেত ১৮৯১ সালের এরফুর্ট কর্মসূচী গ্রহণ করে। খোদ এঙ্গেলসকে সমালোচনা করতে রোজা পিছপা হননি, যিনি কিনা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠায় সম্মতি দিয়েছিলেন যদিও অবশ্য এরফুর্ট কর্মসূচী বিষয়ে এঙ্গেলসের সমালোচনা ছিল। ‘চতুর্থ আগস্ট (১৯১৪) বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত কিছু ছিল না,’ রোজা বলেন: ‘আগস্টেও ৪ তারিখে যা ঘটেছে তা’ এত বছর ধরে আমরা যা কিছু করেছি তার এক যৌক্তিক পরিণতি ছিল।’ যদিও দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠা কর্মসূচীর নথি-পত্রের দিকে রোজার দৃষ্টি ছিল,  তবে তিনি ১৮৭৫ সাল অবধি তাঁর সমালোচনাকে পরিব্যপ্ত করেননি, যখন কিনা মার্ক্স তাঁর ‘ক্রিটিক অফ দ্য গোথা প্রোগ্রাম’-এ তাঁর অনুসারী এবং কর্তৃত্ববাদী সমাজতন্ত্রী ফার্দিনান্দ লাসেলের অনুসারীদের ভেতর গড়ে ওঠা এক অনৈতিক একতাকে আক্রমণ করেন। (চলবে)