ঢাকা, শনিবার ২১, ডিসেম্বর ২০২৪ ২০:০৬:২৮ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
বাতিল হওয়া বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর নাম এখনো চূড়ান্ত হয়নি তাপমাত্রা ও কুয়াশা নিয়ে যা জানাল আবহাওয়া অফিস বনানীর ২২নং বস্তিতে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে কাউন্সিলরদের স্বপদে বহাল চায় না জাতীয় নাগরিক কমিটি সাভারে চলন্ত বাসে ডাকাতি, ছুরিকাঘাতে আহত ৪ উত্তরায় রেস্টুরেন্টে আগুন, ৭ জনকে জীবিত উদ্ধার

`সফদার ডাক্তার`-এর ছড়াকার হোসনে আরা

শাহ আলম বাদশা | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০২:৪৩ পিএম, ১৬ জানুয়ারি ২০২১ শনিবার

`সফদার ডাক্তার`-এর ছড়াকার হোসনে আরা

`সফদার ডাক্তার`-এর ছড়াকার হোসনে আরা

জনপ্রিয় ছড়াকার বা লেখক হতে হলে যে, ২/১টি ছড়া কিংবা হাতেগোনা কিছু বইই যথেষ্ট, ছড়াকার হোসনে আরা (১৯১৬- ৩০ মার্চ ১৯৯৯) তারই জাজ্জ্বল্য এক নজির। একজন সেরা লেখক হতে হলেও যে, শতশত বই থাকতেই হবে, এমন আজগুবি কথারও ভিত্তি নেই। হোসনে আরা বাংলাদেশের জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক ছিলেন, যিনি ছড়াকার হিসেবেই অধিক জনপ্রিয়। তার লিখিত 'সফদার ডাক্তার' নামক শিশুতোষ ছড়াটি চল্লিশের দশকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং বর্তমানেও জনপ্রিয়। একসময়ে এটি বাংলাদেশের পাঠ্য হিসেবে বাংলাবইয়ে পঠিত হতো। যারা ছন্দের পোকা, তাদের জন্য বলি; সেই ৪০ এর দশকে রচিত এই ছড়াটি কতটা আধুনিক ও মানোত্তীর্ণ, তা পড়লেই বোঝা যায়। আর যুগপতভাবে মধ্যমিল ও অনুপ্রাসযুক্ত ৪ মাত্রার মূলপর্বভিত্তিক মাত্রাবৃত্তে রচিত ছড়াটি বেশ মজাদারও। শিশুরা ব্যতীত বড়রাও আরেকবার ছড়াটি পড়ে আমাদের অতীত-স্মৃতিকে ঝালিয়ে নিতেই পারি--
সফদার ডাক্তার মাথাভরা টাক তার
খিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ে,
চেয়ারেতে রাতদিন বসে গোণে দুই-তিন
পড়ে বই আলোটারে নিভিয়ে।
ইয়া বড় গোঁফ তার, নাই যার জুড়িদার
শুলে তার ভুঁড়ি ঠেকে আকাশে,
নুন দিয়ে খায় পান, সারাক্ষণ গায় গান
বুদ্ধিতে অতি বড় পাকা সে।
রোগী এলে ঘরে তার, খুশিতে সে চারবার
কষে দেয় ডন আর কুস্তি,
তারপর রোগীটারে গোটা দুই চাঁটি মারে
যেন তার সাথে কত দুস্তি।
ম্যালেরিয়া হলে কারো নাহি আর নিস্তার
ধরে তারে কেঁচো দেয় গিলিয়ে,
আমাশয় হলে পরে দুই হাতে কান ধরে
পেটটারে ঠিক করে কিলিয়ে।
কলেরার রোগী এলে, দুপুরের রোদে ফেলে
দেয় তারে কুইনিন খাইয়ে,
তারপর দুই টিন পচা জলে তারপিন
ঢেলে তারে দেয় শুধু নাইয়ে।
ডাক্তার সফদার, নাম ডাক খুব তার
নামে গাঁও থরথরি কম্প,
নাম শুনে রোগী সব করে জোর কলরব
পিঠটান দিয়ে দেয় লম্ফ।
একদিন সককালে ঘটল কি জঞ্জাল
ডাক্তার ধরে এসে পুলিশে,
হাত-কড়া দিয়ে হাতে নিয়ে যায় থানাতে
তারিখটা আষাঢ়ের উনিশে।
শিশুসাহিত্যিক হোসনে আরা ১৯১৬ সালে পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার পিয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মুন্সি এবাদুল্লাহ ছিলেন সে সময়কার নামকরা পুঁথিলেখক। আর চাচা ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ফলে সাহিত্যিক পরিবারের সন্তান হয়ে তিনিও সাহিত্যে অবগাহণ করেন। তখন গ্রামের মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ-সুবিধা না থাকায় হোসনে আরাকে মাত্র সাত বছর বয়সে ঢাকায় চাচা ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বাসায় পাঠানো হয়। চাচার বাসায় পড়ালেখার ব্যবস্থা হয় পর্দার আড়ালে, তখন এভাবেই মেয়েদের লেখাপড়া চলতো। পর্দার একপাশে থাকতেন মৌলভি সাহেব আর অন্যপাশে হোসনে আরা এবং তার চাচাতো বোনেরা। এক বছর পরে পুঁথিকবি বাবার অসুস্থতার কারণে হোসনে আরাকে ফিরে যেতে হলো গ্রামে। শেষ হয় তার প্রথাগত শিক্ষা যদিও নিজের চেষ্টায় তিনি অব্যাহত রাখেন স্বশিক্ষাকে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত হোসনে আরাকে মাত্র চৌদ্দবছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের সাথে। বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এই বিখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক দৈনিক মিল্লাত পত্রিকার প্রধানসম্পাদক ছিলেন। হোসনে আরার বিপুল আগ্রহ দেখে তিনি তাকে পড়াশোনার ব্যাপারে যথেষ্ট  সাহায্য করতেন এবং স্বামীর অনুপ্রেরণাতেই হোসনে আরা নবোদ্যমে লিখতে শুরু করলেন। দৈনিক আজাদের ‘মুকুলের মহফিলে’ হোসনে আরার প্রথম ছড়া প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি ‘হাসি’ ছদ্মনামে নামে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রচুর ছড়া লেখেন। ১৯৪৯ সালে তার প্রথম ছড়ার বই ‘ফুলঝুরি’ প্রকাশ হয়। এই বইতেই তার বিখ্যাত ছড়া 'সফদার ডাক্তার' সংকলিত ছিল। কলকাতার ব্যানসন কোম্পানি বইটি প্রকাশ করেছিলেন। বইটি শিশু-কিশোরদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। শিশুদের জন্য তার অন্যবই হলো খেয়াল খুশি, হল্লা, টুংটাং ও হট্টোগোল। তবে ‘মিছিল’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ ও ‘আমার কারাবরণ’ নামে তার  একটি স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থও রয়েছে।
১৯৩২ সালে মাত্র ষোলোবছর বয়সে তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৪৪ ধারাভাঙার মতন অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। সরকারের সববাঁধা পেরিয়ে মিছিল থেকে ছত্রভংগ হয়ে একাই তিনি পতাকা হাতে চলে আসেন কলকাতার গড়ের মাঠের মনুমেন্টের সামনে। তাই ১৪৪ ধারাভঙ্গের অপরাধে তাকে ছয়মাসের জেল দেয়া হয়। আর তিনিই প্রথম বাঙালি নারী যিনি আন্দোলন করে জেল খেটেছিলেন। ৫২'র ভাষা-আন্দোলনে, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজের অবস্থান থেকে অবদান রাখেন তিনি। একাত্তরে তিনি নিজহাতে কাপড়বুনে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের, যা রেডক্রসের মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হতো।
শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার হোসনে আরা শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমি ও ১৯৯২ সালে শিশু একাডেমি পুরস্কার পান।
হোসনে আরা চারপুত্র ও এককন্যা নিয়ে ঢাকার মোহাম্মদপুরে বসবাস করতেন। পারিবারিক জীবনে অত্যন্ত সুখী ছিলেন তিনি। তিনি ১৯৯৯ সালের ৩০ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি এখন অস্তিত্বহীন হলেও  তার সৃষ্টির মাঝেই বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।