ঢাকা, মঙ্গলবার ২৬, নভেম্বর ২০২৪ ৮:৩০:২৬ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
পঞ্চগড়ে জেঁকে বসেছে শীত, তাপমাত্রা নামল ১৩ ডিগ্রিতে ব্রাজিলে বাস খাদে পড়ে ২৩ জনের প্রাণহানী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাব জব্দ ১০ সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাব জব্দ মিরপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, নারী-শিশুসহ দগ্ধ ৭ ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৩৮, লেবাননে ৩৩ প্রাণহানী

সমুদ্র ও সাত মানবী

শান্তা মারিয়া | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:৪৫ এএম, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ শুক্রবার

উপন্যাস : সমুদ্র ও সাত মানবী ৥ শান্তা মারিয়া (চতুর্থ পর্ব)

উপন্যাস : সমুদ্র ও সাত মানবী ৥ শান্তা মারিয়া (চতুর্থ পর্ব)

।চতুর্থ পর্ব।
ফিচারের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ছোট্ট একটি নোটবইতে লিখে নিচ্ছিল কঙ্কনাও। সে রেকর্ডার ব্যবহার করে না। নোটও খুব বেশি নেয় না। তার স্মৃতিশক্তি ভালো। অধিকাংশ তথ্য সে মনেই গেঁথে নেয়। আজকেও বেশিরভাগ সময়ে তাই করছিল। তথ্যের সঙ্গে সঙ্গে তার স্মৃতিতে প্রোথিত হয়ে যাচ্ছিল সুহার্সোও। সুহার্সো তাকে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল সবকিছু। শুধু প্রোজেক্ট নয়, বান্দরবানের অপরূপ প্রকৃতির কথাও বলছিল সে। প্রকৃতি তার অপরূপ লীলার আসর বিছিয়ে চলছিল দুজনের মনেই। সুহার্সো বলছির তার জন্মভূমির কথাও। ইন্দোনেশিয়ার প্রকৃতির সঙ্গে কীভাবে যেন বান্দরবানের প্রকৃতির একটা সাদৃশ্য গড়ে তুলছিল সে। কঙ্কনা তার কথা শুনতে শুনতেই আনমনা হয়ে যাচ্ছিল। কল্পনা করার চেষ্টা করছিল সুহার্সোর বালকবেলা। কোথায় যেন একটা মমতা অনুভব করছিল সে এই জাঁদরেল কান্ট্রি ডিরেক্টরের প্রতি। এই মমতা ছায়া ফেলছিল তার চেহারায়। সুহার্সো সেদিকে তাকিয়ে অনুভব করছিল একটা কোমলতা যা প্রথম তারুণ্যের পর আর অনেকদিন অনুভব করেনি সে। সুহার্সোর কাছে নারী মানেই সমষ্টিগতভাবে তার এনজিওর বিষয়। নারী অধিকার, টার্গেট গ্রুপ আর পলিসির ভিড়ে প্রায়শই হারিয়ে যায় নারীর প্রতি রোমান্টিক কোন আবেগ। একক বা বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসেবে নারীকে অনুভব করা হয়নি বিগত বহু বছর। 

নাহিদ খুব বিরক্ত বোধ করছিলেন গাড়ি থেকে নেমেও সুহার্সোকে শুধু কঙ্কনার সঙ্গেই কথা বলতে দেখে। তিনিও একটি বড় পত্রিকার সাংবাদিক। যদিও আলফাজ তাকে যথেষ্ট খাতির করছেন, কিন্তু কান্ট্রি ডিরেক্টর তাকে পাত্তা দিচ্ছেন না কেন। নাহিদ ঠিক করলেন এই এনজিও সম্পর্কে তিনি খুব সামান্যই লিখবেন। একেবারে না লিখলেই ভালো হতো। কিন্তু তিনি অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে এসেছেন। তাছাড়া এক্সিকিউটিভ এডিটরের সঙ্গে সুহার্সোর বেশ দহরম মহরম। এর আগে এই  সংস্থার প্রোজেক্টে তিনি ঘুরে গেছেন। বলতে গেলে তিনিই বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে নাহিদকে পাঠিয়েছেন। অফিসে ফিরে লেখা জমা না দিলে বেইজ্জতি কারবার। সুহার্সো আর কঙ্কনা দুজনের উপরেই বিরক্ত লাগছিল তার। 

এমনিতে কঙ্কনার সঙ্গে তার সম্পর্ক মন্দ নয়। বহুবার একসঙ্গে ওয়ার্কশপ, সেমিনার করেছেন। বিভিন্ন প্রেস কনফারেন্সে প্রায়ই দেখা হয়। এর আগেও একসঙ্গে ট্যুরে গিয়েছেন। শ্রীলংকায় গিয়েছিলেন একসঙ্গে। সেসময় হোটেলে একরুম শেয়ারও করেছেন। নারী সাংবাদিকদের এই সংগঠনটিতেও দুজনে শুরু থেকে যুক্ত হয়েছেন। সঙ্গী হিসেবে ও খুব মন্দ নয়। অনেক মজার মজার গল্প জানে। হাসাতে পারে খুব। সমাজের অনেক মুখরোচক কেচ্ছাকাহিনী রসিয়ে বলতে ওর জুড়ি নেই। কিন্তু ওর এই দ্রুততালে ভাব জমাবার ক্ষমতাকেই অপছন্দ করেন নাহিদ। অপছন্দ করেন ওর ইংরেজি বলা আর সবসময় সেজেগুজে থাকার প্রবণতাকে। অত রঙের লিপস্টিক ও কোথা থেকে জোগাড় করে কেজানে। নাহিদ নিজে কিছুটা অন্তমুর্খী স্বভাবের। অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গেও খুব একটা মন খুলে কথা বলতে পারেন না। বাড়িতেও তিনি চুপচাপ থাকতে ভালোবাসেন। স্কুলপড়ুয়া ছেলেটাও পেয়েছে তারই স্বভাব। ব্যালকনিতে বেশ একটু বাগান করেছেন নাহিদ। বাড়িতে তিনটা বিড়ালছানা আছে। অফিসের পর এদের সঙ্গে সময় কাটাতেই তার ভালো লাগে। কলেজের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও তেমন যোগাযোগ নেই তার। একমাত্র সুবর্ণার সঙ্গেই তার অনেকটা মিলে যায়। যদিও সুবর্ণা এখন অন্য পত্রিকায় কাজ করেন কিন্তু একসময় দুজনে একই পত্রিকার পাশাপাশি ডেস্কে কাজ করেছেন। তখন দুজনে অনেক সুখ দুঃখ ভাগ করে নিয়েছেন। প্রায় পাঁচ বছর একসঙ্গে কাজ করার মধুর স্মৃতি তাদের দুজনকে আজীবনের সেরা বন্ধুতে পরিণত করেছে। নাহিদের পারিবারিক কোন অনুষ্ঠানে যেমন সুবর্ণার উপস্থিতি অবধারিত তেমনি সুবর্ণার বোনেরাও নাহিদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ। দুজনেরই ইচ্ছা ছিল একই পত্রিকায় সব সময় পাশাপাশি এভাবে কাজ করবেন। কিন্তু পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা আর হয়নি। সাংবাদিকরা তো যাযাবর। আজ এ হাউজে তো কাল ও হাউজে তাদের চলাচল চলতেই থাকে। নাহিদ এখন খুব বড় একটি পত্রিকায় ডেপুটি ফিচার এডিটর হিসেবে কাজ করছেন। এমনকি প্রচার সংখ্যার দিক থেকে সেটি কঙ্কনার পত্রিকার চেয়েও এগিয়ে। এই এনজিওকে তিনি অনেক বেশি প্রচার এনে দিতে পারেন।  তা সত্বেও সুহার্সো তার দিকে মনোযোগ না দিয়ে কঙ্কনার দিকে সব কথোপকথন ঢেলে দিচ্ছেন এটিই অসহ্য লাগছে তার। 

তিনদিন ধরে আলিকদমে, নাইক্ষাংছড়িতে, বৌদ্ধমন্দিরে আর ডুলাহাজরা সাফারি পার্কে সবজায়গাতেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তিতে ভীষণ বিরক্ত বোধ করছিলেন নাহিদ। রাতে একা নিজের রুমে বসে আয়নায় নিজেকেই দেখছিলেন তিনি। সুবর্ণা নাহিদের রুমে এসে নক করলেন। যদিও প্রত্যেককে আলাদা ঘর দেওয়া হয়েছে কিন্তু সুবর্ণা আলাদা ঘরে একা থাকতে নারাজ। তার গা ছমছম করে। তাছাড়া এতদিন পরে তারা দুজন একসঙ্গে ট্যুরে এসেছেন এখন কত গল্প, কত কথা বলার রয়েছে। এখন একা ঘরে চুপচাপ টিভি দেখলে চলবে নাকি। সুবর্ণা তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। কিন্তু বোনেরা তাকে বড়বোনের মতো নয় বরং ছোটবোন হিসেবে সবসময় আদর আহ্লাদ দিয়ে এসেছে। ‘বড় আপি তো বাচ্চাদের মতো, ও কিছু বোঝে না’ এটাই তাদের সাধারণ সংলাপ। তিনি একজন নামী সাংবাদিকের মেয়ে। বাবার হাত ধরেই সাংবাদিকতায় এসেছেন। তার বর্তমান সম্পাদকও একসময় বাবার সহকর্মী ছিলেন। সেই সুবাদে এখনও তিনি সম্পাদককে চাচা ডাকেন, অন্যদের মতো ভাই বলে না ডেকে। লেখার হাত তার ভালো। কিন্তু কর্মক্ষেত্রের ঘোর প্যাচ তার একদম ভালো লাগে না। সাংবাদিকতার মতো জটিল পেশায় তার মতো সরল মানুষের টিকে থাকার কথা নয়। কিন্তু পারিবারিক পরিচিতির জোরে চাকরিটা তার ভালোই চলে যাচ্ছে। বয়সে তিনি নাহিদের চেয়ে বড়। মনের দিক থেকে অনেক নরম প্রকৃতির। বাস্তবিক যতটা নরম প্রকৃতির এবং শিশুসুলভ তাকে মনে হয় ততোটা তিনি নন। তবে তিনি জানেন সরলতার এই ইমেজটা তাকে মানায়। এটা তার ঠিক ভান নয়, অনেকটা অভ্যাস। অধিকাংশ সময়ই তিনি দেখাতে চান তিনি তেমন কিছু বোঝেন না। তার এই সরলতাকে সহকর্মীরা উপভোগ করেন। নাহিদও। নাহিদ ও অন্যরা প্রায়ই সুবর্ণার এই সরলতা নিয়ে তার সামনেই ঠাট্টা করেন। প্রকৃত সত্য হলো জীবনের অনেক জটিলতাকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে তাকে। বাবার আদরের অনুগত মেয়ের ভূমিকা পালন করতে হয়েছে শৈশব থেকে। স্বামীকে সেভাবে ভালোবাসতে পারেননি তিনি কোনদিনই। আবার অন্য কারও সঙ্গে যে সম্পর্ক গড়বেন সে সাহসও তার ছিল না কখনও। সুদর্শনা সুবর্ণার প্রতি ছাত্রজীবনে আকৃষ্ট হয়েছিল অনেকেই। এদের মধ্যে একজনের প্রতি তার বেশ দুর্বলতাও ছিল। কিন্তু বাবা মা মেনে নেবেন কিনা, ছেলেটি ভালো কি না এসব দ্বিধাচল তিনি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আর তারপরই তার বিয়ে হয়ে যায় চিকিৎসক হাসান আহমেদের সঙ্গে। বাবা মায়ের পছন্দ করা সুরক্ষিত জীবন। কিন্তু ডক্টর হাসানের ভালো চাকরি থাকলেও আকর্ষণীয় অবয়ব ছিল না। অন্তত সুবর্ণা তার প্রতি আকৃষ্ট হতে পারেননি। নিজের বিরাগ প্রকাশ করার মতো সাহসীও তিনি নন। এমনকি বিয়ের পরও তার প্রতি যে সব পুরুষ আকৃষ্ট হয়েছে তাদের কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর সাহসও তার হয়নি। চরিত্র হারানোর সাহস হয়নি বলেই কি তিনি চরিত্রবান, এ প্রশ্নটি মাঝেমধ্যে নিজেকে করেন। আবার উত্তরটির দিকে তাকাতেও ভয় হয় তার। এক রকম মেনে নেওয়া বহমান জীবন। এই অতৃপ্তি তাকে নিঃশব্দে দহন করে। আজকাল নিজের কিশোর বয়সী সন্তানরাও তার সঙ্গে মাতব্বরি চালে কথা বলে। তিনিও চান এই দ্বিধাময় মেনে নেওয়া জীবন থেকে বের হয়ে নিজের স্বাধীন সিদ্ধান্তে চলতে। কিন্তু নাহিদ ছাড়া আর কাউকে সাহস করে সেকথাও বলতে পারেননি। এমনকি ঘনিষ্ট বান্ধবীদেরও নয়। যদি তারা মনে করে সুবর্ণা সুখী নয়। যদি করুণা করে কেউ, যদি উপহাস করে। কঙ্কনাকে বিশেষভাবে সুবর্ণা ঈর্ষা করেন ওর দৃঢ়তার জন্য যার একান্ত অভাব তার নিজের ভিতরে। গত তিনদিন কঙ্কনা যখন কখনও ফতুয়া, কখনও টিশার্ট পরে অনেকেরই সপ্রশংস দৃষ্টি কুড়ালো তখন সুবর্ণার আফশোস হয়েছিল। কারণ ব্যাগে করে তিনিও একটি ফতুয়া ও জিন্স এনেছেন। পরবেন ভেবেও ছিলেন। পরলে হয়তো ছোটখাটো দেহের কঙ্কনার চেয়ে দীর্ঘাঙ্গী তাকেই বেশি মানাতো। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারেননি। গত বছর প্রেসক্লাবের পিকনিকে গানের তালে তালে কঙ্কনা যখন নাচলো তখন তারও ইচ্ছা হয়েছিল আনন্দ করতে। কিন্তু কে কী বলবে এই চিন্তায় চুপচাপ সোফাতেই বসে থাকতে হয়েছে। কঙ্কনার স্বামীকে প্রেসক্লাবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি বহুবার দেখেছেন। তাকে তার বেশ ভালোও লাগে। কঙ্কনার অ্যাফেয়ার ম্যারেজ তিনি জানেন। ছাত্রজীবনে এমন একজন ছেলেকেই তার ভালো লাগতো। কিন্তু কঙ্কনার মতো সাহস করে তার হাত ধরা হয়নি। কঙ্কনা আজ যা যা পেয়েছে সেসব পাওয়ার যোগ্যতা তারও ছিল, হয়তো ওর চেয়ে বেশিই ছিল কিন্তু সাহসের অভাবেই তা তিনি পাননি। এসব কথা যতই ভাবেন, ততোই তিনি ঈর্ষা করেন কঙ্কনাকে। ও কেমন দিব্যি জমিয়ে নিয়েছে সুহার্সোর সঙ্গে। সুবর্ণাও ইংরেজি ভালোই জানেন। কিন্তু পাছে ভুল হয়ে যায় এই ভয়ে বলতে পারেন না। তিনি খেয়াল করেছেন কঙ্কনা অনেক ভুল ইংরেজি বলে। তারপরও দিব্যি কথা চালিয়ে যেতে পারে।

চলবে...