ঢাকা, সোমবার ২৫, নভেম্বর ২০২৪ ৪:৩৮:১২ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাব জব্দ ১০ সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাব জব্দ মিরপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, নারী-শিশুসহ দগ্ধ ৭ ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৩৮, লেবাননে ৩৩ প্রাণহানী প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়েই প্রিয়াঙ্কার বাজিমাত বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন ব্রিটিশ রাজা চার্লস

স্বর্ণকুমারী দেবী: আধুনিকতায় অগ্রসর এক অনন্য নারী

অঞ্জনা রাণী চৌধুরী  | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০১:১০ পিএম, ২৯ আগস্ট ২০২২ সোমবার

ফাইল ছবি।

ফাইল ছবি।

স্বর্ণকুমারী দেবী; বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী ঔপন্যাসিক।  শুধু ঔপন্যাসিকই নয়, তিনি ছিলেন একাধারে একজন সফল কবি, সাংবাদিক, সংগীতকার ও সমাজ সংস্কারক। তিনিই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য নারী সাহিত্যিক।  স্বর্ণকুমারী দেবী আধুনিকতায় অগ্রসর এক অনন্য নারী। মেধা ও মননে নিজের সময়ের চেয়ে কয়েক ধাপ বেশি এগিয়ে ছিলেন তিনি।  সে যুগের মেয়েদের অনুকরণীয় এক নাম স্বর্ণকুমারী। 
এই অনন্য সাধারণ নারী ১৮৫৫ সালের ২৮ আগস্ট কোলকাতায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদাসুন্দরী দেবীর কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করেন।
স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্রী এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা। তার তিন বড় বোনের নাম সৌদামিনী, সুকুমারী ও শরৎকুমারী। তার ছোটো বোনের নাম ছিল বর্ণকুমারী। সৌদামিনী ছিলেন বেথুন স্কুলের প্রথম যুগের ছাত্রী।  ঠাকুর পরিবারের অন্যান্য মেয়েরা তাকে অনুসরণ করলেও, স্বর্ণকুমারী দেবী প্রধানত বাড়িতেই লেখাপড়া শিখেছিলেন। তিনি তার ছোট ভাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো ছিলেন।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে শিক্ষার পরিবেশ ছিল। দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ শিক্ষার প্রসারের বিষয়ে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, বিদ্যালয়ের তুলনায় বাড়িতেই তারা অধিক শিক্ষালাভ করেছিলেন। স্বর্ণকুমারী দেবীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, তাদের শিক্ষয়িত্রী শ্লেটে কিছু লিখে দিতেন, সেই লেখাটিই তারা টুকে লিখতেন। দেবেন্দ্রনাথ এ কথা জানতে পেরেই এই যান্ত্রিক শিক্ষাদান পদ্ধতিটি তুলে দেন। পরিবর্তে তিনি অযোধ্যানাথ পাকড়াশি নামে এক দক্ষ শিক্ষককে নিয়োগ করে মেয়েদের লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা করেন।
১৮৬৮ সালে জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবীর বিবাহ হয়।  জানকীনাথ ছিলেন নদিয়া জেলার এক জমিদার পরিবারের শিক্ষিত সন্তান।  ঠাকুর পরিবার ছিল পিরালী থাকভুক্ত ব্রাহ্মণ।  পিরালী ব্রাহ্মণ বংশের কন্যাকে বিবাহ করার জন্য জানকীনাথ পরিবারচ্যূত হয়েছিলেন।  কিন্তু দৃঢ়চেতা জানকীনাথ ব্যবসা করে সাফল্য অর্জন করেন এবং নিজস্ব এক জমিদারি গড়ে তুলে ‘রাজা’ উপাধি অর্জন করেন।  তিনি ছিলেন একজন দিব্যজ্ঞানবাদী (থিওজফিস্ট) এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তথা আদি যুগের সক্রিয় সদস্য।
জানকীনাথ ও স্বর্ণকুমারী দেবীর তিন সন্তান।  তারা হলেন হিরন্ময়ী দেবী (১৮৭০ – ১৯২৫), জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল (১৮৭১ – ১৯৬২) ও সরলা দেবী চৌধুরাণী (১৮৭২ – ১৯৪৫)। জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল আইসিএস পরীক্ষায় পাশ করে পশ্চিম ভারতে চাকরি করেছিলেন।
সংগীত, নাটক ও সাহিত্যে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পুরুষ সদস্যদের সৃষ্টিশীলতা স্বর্ণকুমারী দেবীকেও স্পর্শ করেছিল।  এই সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এই তিন ক্ষেত্রে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন।  তাকে সাহায্য করছিলেন অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথ। 
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি থেকে জানা যায়, জানকীনাথ ইংল্যান্ডে গেলে স্বর্ণকুমারী দেবী জোড়াসাঁকোয় এসে থাকতে শুরু করেছিলেন। এই সময় তিনিও তাদের সঙ্গে নতুন পরীক্ষানিরীক্ষায় মেতে ওঠেন।  জ্ঞানদানন্দিনী দেবী যখন পরিবারের প্রাচীন প্রথাগুলিকে নারী স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করছিলেন, ঠিক সেই সময় স্বর্ণকুমারী দেবী সাহিত্য সাধনায় মগ্ন ছিলেন।
১৮৭৬ সালে স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস দীপনির্বাণ প্রকাশিত হয়। ইতিপূর্বে ১৮৫২ সালে হানা ক্যাথরিন মুলেনস তার ফুলমণি ও করুণার বৃত্তান্ত প্রকাশ করে বাংলা ভাষার প্রথম ঔপন্যাসিকের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। কিন্তু স্বর্ণকুমারী দেবীই ছিলেন প্রথম বাঙালি নারী ঔপন্যাসিক।
দীপনির্বাণ ছিল জাতীয়তাবাদী ভাবে অনুপ্রাণিত এক উপন্যাস। এরপর স্বর্ণকুমারী দেবী একাধিক উপন্যাস, নাটক, কবিতা ও বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান-পরিভাষা রচনার বিষয়ে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি অসংখ্য গানও রচনা করেছিলেন। সেই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বর্ণকুমারী দেবী বা কামিনী রায়ের মতো নারী সাহিত্যিকদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।  তারা ছিলেন শিক্ষিত বাঙালি নারীসমাজের প্রথম যুগের প্রতিনিধি। সেই হিসাবে তাদের দায়িত্বগুলি সাহিত্যরচনার মাধ্যমে পালন করে গিয়েছিলেন তারা।
১৮৭৯ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী প্রথম বাংলা গীতিনাট্য (অপেরা) বসন্ত উৎসব রচনা করেন। পরবর্তীকালে তার অনুজ রবীন্দ্রনাথ এই ধারাটিকে গ্রহণ করে সার্থকতর গীতিনাট্য রচনায় সফল হয়েছিলেন।
১৮৭৭ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পারিবারিক পত্রিকা ভারতী চালু করেন। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বিজেন্দ্রনাথ সাত বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। এরপর এগারো বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেন স্বর্ণকুমারী দেবী। তিনি এই পত্রিকার স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। এই পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হত। এর ভাষাও ছিল সহজ সরল। সমালোচকেরা এই পত্রিকার উচ্চ প্রশংসা করতেন। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যারা বারো বছর ও রবীন্দ্রনাথ এক বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। এরপর আট বছর স্বর্ণকুমারী দেবী আবার এই পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তারপর নয় বছরের ব্যবধানে আবার স্বর্ণকুমারী দেবী এই পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। এরপর দুই বছর সম্পাদনার পর তিনি পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। এই ভাবে ভারতী পত্রিকা প্রায় অর্ধশতাব্দীকালব্যাপী প্রকাশিত হয়।
ভারতী যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল মাত্র ষোলো। প্রথম সংখ্যা থেকেই এই পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। আসলে এই পত্রিকার চাহিদাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়মিত লিখতে বাধ্য করত এবং বহু বছর তিনি এক নাগাড়ে এই পত্রিকায় নিজের লেখা পাঠিয়ে এসেছিলেন।
স্বর্ণকুমারী দেবীর স্বামী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি নিজেও সামাজিক সংস্কার ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৯ ও ১৮৯০ সালে পণ্ডিতা রামাবাই, রামাবাই রানাডে ও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনিও জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে অংশ নেন। তিনিই ছিলেন প্রথম নারী যিনি জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
অনাথ ও বিধবাদের সাহায্যার্থে ১৮৯৬ সালে ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে স্বর্ণকুমারী দেবী ‘সখীসমিতি’ স্থাপন করেন। ১৮৯৮ সালে ভারতী ও বালক পত্রিকায় নিম্নলিখিত প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়:
সখীসমিতির প্রধান উদ্দেশ্য হল অসহায় অনাথ ও বিধবাদের সহায়তা করা। এই কাজ দু'ভাবে করা হবে। যেক্ষেত্রে এই সব বিধবা ও অনাথদের কোনো নিকটাত্মীয় নেই বা থাকলেও তাদের ভরণপোষণের ক্ষমতা সেই আত্মীয়দের নেই, তাদের ভরণপোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সখীসমিতি নেবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে সখীসমিতি তাদের যথাসাধ্য সাহায্য করবে। সখীসমিতি যে সব মেয়েদের পূর্ণ দায়িত্ব নেবে, তাদের লেখাপড়া শিখিয়ে স্ত্রীশিক্ষার প্রসার ঘটাবে। তারা শিক্ষা সম্পূর্ণ করে অন্যান্য মহিলাদের লেখাপড়া শেখাবেন। সমিতি এই জন্য তাদের পারিশ্রমিকও দেবে। এইভাবে দু'টি উদ্দেশ্য সাধিত হবে। হিন্দু বিধবারা হিন্দুধর্মের অনুমোদনক্রমেই শ্রমদানের মাধ্যমে উপার্জনক্ষম হয়ে উঠবেন।
সংগঠন পরিচালনা কেবলমাত্র সদস্যদের চাঁদায় সম্ভব নয় অনুভব করে, স্বর্ণকুমারী দেবী বেথুন কলেজে একটি বার্ষিক মেলার আয়োজন করেন। এই মেলায় ঢাকা ও শান্তিপুরের শাড়ি, কৃষ্ণনগর ও বীরভূমের হস্তশিল্প এবং বহির্বঙ্গের কাশ্মীর, মোরাদাবাদ, বারাণসী, আগ্রা, জয়পুর ও বোম্বাইয়ের হস্তশিল্প প্রদর্শিত হয়। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ভারতের দেশজ পণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা। সেই যুগে এই মেলা কলকাতার সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
১৯০৬ সাল পর্যন্ত সখীসমিতি সক্রিয় ছিল। তারপর হিরন্ময়ী বিধবা আশ্রয়-এর দায়িত্ব গ্রহণ করে। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায় বরানগরে একটি বিধবা আশ্রম চালু করেন। এই আশ্রমের নাম ছিল ‘মহিলা বিধবা আশ্রম’। 
হিরন্ময়ী দেবীর মৃত্যুর পর এই আশ্রমটিরই নতুন নামকরণ হয় ‘হিরন্ময়ী বিধবা আশ্রম’। বিধবা আশ্রমের প্রতিষ্ঠাকালীন কার্যনির্বাহী সমিতিতে ছিলেন স্বর্ণকুমারী, ময়ূরভঞ্জের মহারানি সুচারু দেবী, কোচবিহারের মহারানি সুনীতি দেবী (দুজনেই ছিলেন কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা), লেডি হ্যামিলটন, প্রিয়ংবদা দেবী, শ্রীমতী চ্যাপম্যান ও শ্রীমতী সিংহ।  হিরন্ময়ী দেবী ছিলেন আশ্রমের সচিব। হিরন্ময়ী দেবীর কন্যা তথা আশ্রমের পরিচালিকা কল্যাণী মল্লিকের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৪৯ সালেও এই আশ্রম সফলভাবে চালু ছিল।
‘সখীসমিতি’ নামটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। সরলা রায়ের অনুরোধে সখীসমিতির অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্যটি লিখে মঞ্চস্থ করেছিলেন।
স্বর্ণকুমারী দেবীর উপন্যাস: দীপনির্বাণ (১৮৭৬), মিবার-রাজ (১৮৭৭), ছিন্নমুকুল (১৮৭৯), মালতী (১৮৭৯), হুগলীর ইমামবাড়ী (১৮৮৭), বিদ্রোহ (১৮৯০), স্নেহলতা (১৮৯২), কাহাকে (১৮৯৮), ফুলের মালা (১৮৯৫), বিচিত্রা (১৯২০), স্বপ্নবাণী (১৯২১), মিলনরাতি (১৯২৫)। সাব্বিরের দিন রাত [১৯১২]। নাটক: বিবাহ-উৎসব (১৮৯২), রাজকন্যা, দিব্যকমল।
কাব্যগ্রন্থ: গাথা, বসন্ত-উৎসব, গীতিগুচ্ছ।
বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ: পৃথিবী সম্পর্কে জানা যায়।
১৯২৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণকুমারী দেবীকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯২৯ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন।
মহীয়সী এই নারী ১৯৩২ সালের ৩ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।